অনেকে দীর্ঘদিন ধরে রুকইয়াহ করেন, সব নির্দেশনা ঠিক মতই অনুসরণ করেন। এরপরও দেখা যায় সুস্থ হতে দেরি লাগছে। কেউ আবার কয়েকদিন বা সারা সপ্তাহে কয়েক মিনিট রুকইয়াহ করেই জিজ্ঞেস করেন, আমার এত দেরি লাগছে কেন?
এখানে অনেকেই যে ভুলটা করে থাকেন, সেটার ব্যাখ্যা দিচ্ছি। তাঁরা ভাবেন, যেহেতু আমি সঠিক পদ্ধতিতেই রুকইয়াহ করছি, সুতরাং দুই দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে! এটা আর কিছুই না, আশা আর বাস্তবতার ফারাক। যদি ডাক্তার কাউকে বলে, আপনার ক্যানসার হয়েছে, কেমোথেরাপী দরকার। তখন কি সে একবার থেরাপি দিয়েই সুস্থ হয়ে যাওয়ার আশা করবে? নাকি ডাক্তারকে এক সপ্তাহ পরেই বলবে যে, আমি কেন সুস্থ হচ্ছি না? না! সে এমনটা করবে না। কারণ সে ধরেই নিয়েছে তাকে পুরো এক বা দুই বছর চিকিৎসা নিতে হবে, এরপর সুস্থ হবে।
নিজের অভিজ্ঞতা বলি, আমি মাত্র তিনদিন রুকইয়াহ করে যাদু আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ হতে দেখেছি, আবার এমনও দেখেছি দেড় বছর ধরে রুকইয়াহ করছে, কিন্তু এখনও সব সমস্যা ভালো হয়নি। আধাঘণ্টার রুকইয়াতে যেমন শরীর থেকে জ্বিন চলে যেতে দেখেছি, তেমনি এটাও দেখেছি প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ঘন্টা করে এক সপ্তাহ রুকইয়াহ করার পর জ্বিন সরেছে, এরপরও সব লক্ষণ দূর হয়নি। সুতরাং আপনার বিশ্বাস করা উচিত সমস্যার প্রসারতা এবং গভীরতা অনুযায়ী সুস্থ হতে কম-বেশি সময় লাগতে পারে। তাই কদিন রুকইয়াহ করার পরেই আশা ছেড়ে দেয়া যাবে না। অতি আশা ছেড়ে আপনাকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ এই চিকিৎসা আপনার ও শয়তানের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অনেক গুলো ছোট ছোট লড়াই আছে, সে লড়াইয়ে কখনো আপনি জিতবেন, কখনো আপনি হারবেন। এই সব কিছুর পিছনে আল্লাহর হিকমাহ লুকিয়ে আছে। আপনার কাজ হবে চেষ্টা করে যাওয়া, ফায়সালা আল্লাহর হাতে।
রাসূল ﷺ ছিলেন এমন ব্যক্তি যিনি আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের দিকে পরিপূর্ণ, যার দু’আ কবুল করা হতো, যিনি কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত, যার ভবিষ্যত ও অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে; এতকিছুর পরেও রাসূলুল্লাহ ﷺ বিশ বছরেরও বেশি সময় তাঁর শত্রুর বিরুদ্ধে মেহনত এবং যুদ্ধ করেছেন। দুনিয়ার বুকে রাসূলুল্লাহ ﷺ সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ হওয়া স্বত্বেও আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গীদের বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরীক্ষা করেছেন। এরপরই মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছে। আল্লাহ এ সম্পর্কে কুর’আনে বলেছেনঃ
ن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُۚ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَاءَ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
“যদি তোমরা আহত হয়ে থাকো, তেমনি তারাও আহত হয়েছে। এবং এই (জয়-পরাজয়ের) দিনগুলোকে আমরা মানুষের মধ্যে পালাক্রমে বদল করি, যেন আল্লাহ জেনে নিতে পারেন কারা ঈমান এনেছে। আর তিনি তোমাদের মধ্যে থেকে কাউকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ জালিমদের ভালোবাসেন না।” (সুরা আলে ইমরান-১৪০)
এই আয়াতে আল্লাহ ব্যাখ্য করেছেন, কেন উহুদের যুদ্ধে কাফিররা সীমিতভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবাদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলো। এভাবে আল্লাহ মাঝে মাঝে তাঁর শত্রুদের অবকাশ দেন, যাতে তিনি মুসলিমদের ঈমানকে পরিক্ষা করতে পারেন, আর কতককে শহীদ হিসেবে কবুল করে নিতে পারেন। এটাই আল্লাহর হিকমাহ।
তাই একজন রোগীকে এই ব্যাপারে ধৈর্য্য ধরতে হবে, সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে যেতে হবে, আর আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। আল্লাহ যখন চাইবেন সুস্থতা দিবেন, অথবা চাইলে পরীক্ষা করবেন। ফলে আক্রান্ত অবস্থাতেই মৃত্যু হবে, এর প্রতিদান আল্লাহ আখিরাতে দিবেন।
আবূ সাঈদ খুদরী এবং আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেনঃ মুসলিম ব্যাক্তির উপর যে সকল কষ্ট, রোগ ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুঃশ্চিন্তা, পেরেশানী আপতিত হয়, এমনকি যদি তার দেহে একটি কাঁটাও বিদ্ধ হয়, এসব প্রতিটি বিপদে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন। (বুখারি ৫৩১৮)
আতা ইবনে আবি রাবাহ রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস ؓ আমাকে বললেন, আমি কি তোমাকে একজন জান্নাতী মহিলা দেখাবো? আমি বললাম অবশ্যই। তখন তিনি বললেনঃ এই কৃষ্ণ বর্ণের মহিলাটিকে দেখ, সে রাসূল ﷺ এর কাছে আবেদন করেছিল, তাঁর মৃগী রোগ আছে তাই সুস্থতার জন্য যেন দোয়া করা হয়। রাসূল ﷺ বললেন, তুমি যদি সবর করতে চাও, করতে পার। বিনিময়ে তোমার জন্য থাকবে জান্নাত। আর তুমি চাইলে আমি আল্লাহর কাছে দু’আ করতে পারি, যেন তোমাকে সুস্থতা দেন। মহিলা বলল আমি ধৈর্য ধারণ করবো। (বুখারি ৫৩২৮)
সুতরাং আপনি যদি সবর করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আল্লাহর কাছে এর বড় প্রতিদান পাবেন।
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُمۖ مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّىٰ يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ اللَّهِۗ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে অথচ তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের মত পরিস্থিতি তোমাদের উপর আসবে না? বিভিন্ন বিপদ ও কষ্ট তাদের স্পর্শ করেছিল। আর তাঁরা এমনভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল যে, নবী ও তাঁর সাথের ইমানদাররা পর্যন্ত বলে উঠেছিল ‘কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য!’ জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।” (সুরা বাক্বারাহ-২১৪)
তৃতীয়তঃ রুকইয়ার ক্ষেত্রে কোরআন আপনার হাতিয়ার। আচ্ছা! তাহলে ব্যপারটা এমনও হতে পারে, আপনার অস্ত্র ঠিকই আছে, কিন্তু যে হাত অস্ত্র ধরে আছে সেটি দুর্বল। কিংবা এমনও হতে পারে আপনার হাতটি শক্তিশালী কিন্তু লক্ষ দুর্বল। তাই আপনার নিজেকে যাচাই করতে হবে। বারবার মিলিয়ে দেখতে হবে, কিছু বাদ যাচ্ছে কি? রুকইয়ার পদ্ধতি ঠিক আছেতো? নিয়াত ঠিক আছে কি? রুকইয়াহ করা কম হচ্ছে নাতো? কিংবা পেছনে কোন বড় গুনাহ আছে কি? যা থেকে তাওবাহ করেননি, ফলে আল্লাহর সাহায্য আসতে দেরী হচ্ছে।
এরকম অবস্থায় আপনার উচিত নিজের আত্মোন্নয়নের দিকে মনোযোগী হওয়া। আত্মসমালোচনা বা নিজ কাজের পর্যালোচনা সবসময়ই সফলতার একটি পন্থা। কিন্তু এটাও খেয়াল রাখতে হবে, নিজের সমালোচনা যেন এমন পর্যায়ের না পৌছায়, যাতে আপনি আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যাচ্ছেন। যেমন ইয়াক্বুব ؑ বলেছিলেনঃ “হে আমার সন্তানেরা! যাও, ইউসুফ ও তাঁর ভাইকে খুঁজে বের করো, আর আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই কাফিররা ছাড়া আল্লাহর রহমত থেকে কেউ নিরাশ হয় না।” (সুরা ইউসুফ-৮৭)
শেষ কথা হচ্ছে, যদি দেখেন রুকইয়ার কারণে সমস্যা কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে, তাহলে ভয়ের কিছু নেই। আপনার উচিত শুকরিয়া আদায় করা, কারণ রুকইয়াহ কাজ করছে। আপনার চিন্তিত হওয়া উচিত দু’টি অবস্থায়-
১. যদি দেখেন কয়েকমাস সব কিছু ঠিকমত করার পরেও সামগ্রিক অবস্থার কোন উন্নতি নেই।
২. যদি রুকইয়াতে কোনই ইফেক্ট না হয়। না উন্নতি; আর না অবনতি। সমস্যা এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে।
এই পোস্টের আরও বিস্তারিত তথ্য রুকইয়াহ বিষয়ক বই প্রকাশিত হলে পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
মন্তব্য করুন