Ruqyah Support BD

সালাফের মূল্যায়ন এবং নজর লাগার লক্ষণ : বদনজর ২

গতপর্বে আমরা বদনজরের বাস্তবতার পক্ষে কোরআন এবং হাদিস থেকে আলোচনা করেছি, আজ প্রথমে আমরা বদনজরের কারণ সমূহ এবং সালাফে সালেহিনের দৃষ্টিতে এর মূল্যায়ন জানবো। এরপর নজর লাগার লক্ষণ আলোচনা করবো।

ইবনে কাসির রহ. বলেন- বদনজর এর প্রতিক্রিয়া সত্য, যা আল্লাহর নির্দেশেই হয়ে থাকে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ৪/৪১০)
হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বদনজরের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “বদনজর বলতে বুঝায়, কোন উত্তম বস্তুকে খারাপ কোনো লোক হিংসার নজরে দেখে, যার কারণে উক্ত বস্তুর ক্ষতিসাধন হয়!” (ফাতহুল বারি, ১০/২০০)
তবে ইবনে হাজার রহ. এর এই সংজ্ঞার সাথে অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম একমত নন, অধিকাংশের মত হচ্ছে ভালো-খারাপ সব লোকের নজরই লাগতে পারে। নফসে আম্মারা তো সবার ভেতরেই আছে তাইনা? কিছু সাহাবির ঘটনা সামনে আসবে, তখন আরো আলাপ হবে ইনশাআল্লাহ।

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন– কিছু লোক অজ্ঞতার কারণে বদনজরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে থাকে। যুগে যুগে জ্ঞানী ব্যক্তিদের মাঝে যদিওবা নজর লাগার কারণ, পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে কেউ একে অস্বীকার করেনি।
যাদুল মা’আদ গ্রন্থে ইবনুল কায়্যিম রহ. এবিষয়ে বেশ দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, যেখান থেকে কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করা যায়.. উনার মতে
– আল্লাহ মানুষের শরীরে এবং আত্মায় বিভিন্ন প্রকার ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। বদনজরের ব্যাপারটা মূলত আত্মিক। কোনো কিছুর প্রতি মুগ্ধতা অথবা হিংসা থেকে অন্তরের এটা সৃষ্টি হয়ে চোখের মাধ্যমে প্রভাব ফেলে। এখানে চোখের শক্তি নেই। এজন্য অন্ধ ব্যাক্তির বদনজরও লাগতে পারে!!!
– বদনজর কখনো যোগাযোগের মাধ্যমে, কখনো সরাসরি দৃষ্টিপাতে, কখনো বদদোয়া বা তাবিজের মাধ্যমে, আবার কখনো ধ্যানের মাধ্যমেও হয়ে থাকে।
– কখনো মানুষের নিজের নজর নিজেকেই লাগে।
– নজর ইচ্ছাকৃত – অনিচ্ছাকৃত যেকোনোভাবে লাগতে পারে। (১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৬৩,১৬৪,১৬৫)

জিনের বদনজর মানুষকে লাগতে পারে, উদাহরণ হিসেবে দুটি হাদিস খেয়াল করুন।

১. আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগে দু’আ করার সময় প্রথমে জিনের বদনজর থেকে পানাহ চাইতেন, তারপর মানুষের নজর থেকে পানাহ চাইতেন। পরে সুরা নাস ফালাক নাযিল হওয়ার পর এই দুটি দিয়ে দুয়া করতেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

২. উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. উনার ঘরে এক বালিকাকে দেখলেন যার চেহারায় বদনজরের আলামত ছিলো। রাসূল সা. বললেন- এর জন্য রুকয়া (ঝাড়ফুঁক) করো, একে জিনের বদনজর লেগেছে। (বুখারি, মুসলিম)

বদনজর কখনো রোগের কারণ হয়, আবার কখনো সরাসরি ক্ষতি করে। নজর লেগে কারো জ্বর চলে আসতে পারে, ডাইরিয়া হতে পারে (নজর লেগে পেট খারাপ হওয়া খুবই কমন ব্যাপার, গতমাসেও আমার এক রিলেটিভের হয়েছিলো) আবার নজর কখনো হৃদরোগের কারণও হতে পারে। আরো অনেক রোগ হতে পারে। ফসল কিংবা গাছের ফলও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ইত্যাদি ইত্যাদি!

ছোটবেলায় কোনো উস্তাযের মুখে শুনেছিলাম, ইমাম বুখারি রহ. যদি জানতেন অমুক ব্যক্তির রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়ার অভ্যাস আছে তাহলে নাকি তাঁর থেকে হাদিস রিওয়ায়েত করতেন না! কারণ তাঁর খাবারের দিকে মানুষের নজর পড়তে পারে, যা স্মৃতিশক্তি দূর্বল করে দিতে পারে… এজন্য হতে পারে হাদিস বর্ণনায় সে ভুল করবে!!
(আল্লাহই ভালো জানে..)

মুম্বাইয়ের একজন অভিজ্ঞ আলেম মুফতি জুনাইদ সাহেব নজর লাগার অনেকগুলো আলামত বর্ণনা করেছিলেন। যেমনঃ

১। শরীরে জ্বর থাকা, কিন্তু থার্মোমিটারে না উঠা।
২। কোনো কারণ ছাড়াই কান্না আসা..
৩। প্রায়সময় কাজে মন না বসা, নামায যিকর ক্লাসে মন না বসা।
৪। প্রায়শই শরীর দুর্বল থাকা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব লাগা।
৫। চেহারা ধুসর/হলুদ হয়ে যাওয়া।
৬। বুক ধড়পড় করা, দমবন্ধ অস্বস্তি লাগা। 
৭। অহেতুক মেজাজ বিগড়ে থাকা।
৮। আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের সাথে দেখা হলেই ভালো না লাগা।
৯। অতিরিক্ত চুল পড়া। শ্যাম্পুতে কাজ না করা।
১০। পেটে প্রচুর গ্যাস হওয়া। 
১১। বিভিন্ন সব অসুখ লেগে থাকা, দীর্ঘদিন চিকিৎসাতেও ভালো হয় না। (সর্দিকাশি, মাথাব্যথা ইত্যাদি)
১২। হাত-পায়ে মাঝেমধ্যেই ব্যাথা করা, পুরো শরীরে ব্যাথা দৌড়ে বেড়ানো। 
১৩। ব্যবসায় ঝামেলা লেগে থাকা।
১৪। যে কাজে অভিজ্ঞ সেটা করতে গেলেই অসুস্থ হয়ে যাওয়া।
১৫। স্বপ্নে উঁচু থেকে পড়ে যেতে দেখা, মৃত মানুষ দেখা। অথবা স্বপ্নে কাউকে মরে যেতে দেখা।

আরো কি কি যেন আছে, আমার ঠিক ইয়াদ নাই। তো যাইহোক, উল্লেখিত বিষয়গুলো এমন না যে শুধু বদনজরের কারণেই এসব হয়, অন্য কারণেও হতে পারে। তবে এরমাঝে কয়েকটা থাকলে আপনি ধরে নিতে পারেন, আপনার কিছু না কিছু সমস্যা আছে। যদি অনেকগুলো থাকে তাহলে অনেক।

নজর থেকে বাঁচার পন্থাও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়ে দিয়েছেন। আসলে বদনজর, জিন, যাদু এই বিষয়গুলোতে আক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি প্রতিরোধ করা যায় তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়।

শেষে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় বলি।

আশার কথা হচ্ছে, যেকোনো ভালো কিছু কেউ দেখলেই বদনজর লাগবে.. এই আতংকে ভুগার দরকার নেই। এরকম হলে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত বহুত আগেই!
বাস্তবতা হচ্ছে, নজর লাগে সাধারণত ইউনিক জিনিশে। সবারই বাম্পার ফলন হয়েছে, এই অবস্থায় কোনো নজর লাগেনা সাধারণত। কিন্তু গোটা পাড়ায় সবার অবস্থা করুণ, আপনার জমিতে অনেক ভালো ফসল হয়েছে। এখানে হিংসুকের নজর লাগার সম্ভাবনা আছে

<<আগের পর্ব |  (বদনজর-৩) পরের পর্ব >>

মন্তব্য করুন