গতপর্বে কোরআন – হাদিস থেকে যাদু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, এবার আমরা কয়েকজন সালাফের মতামত দেখি।
১. ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন- আহলুস সুন্নাত এব্যাপারে একমত যে, যাদু সত্য এবং এর প্রভাব রয়েছে। কিছু মুতাযিলা এটি অস্বীকার করে, এবং বলে এটা শুধুই চোখের ভ্রম। (এরপর ইমাম কুরতুবী রহ. মুতাযিলা ফিরকার আক্বিদা খণ্ডন করেছেন) [তাফসিরে কুরতুবী ২/৪৭ দ্রষ্টব্য]
২. নববী রহ. বলেন- বিশুদ্ধ মত হচ্ছে যাদুর অস্তিত্ব রয়েছে, বেশিরভাগ আলেমের মত এটাই। আর এব্যাপারে কোরআন হাদিসেও সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। [ফাতহুল বারি, ১০/২২২]
৩. ইবনে ক্বুদামা রহ. বলেন- এর দ্বারা হত্যা করা হয়। যাদুর প্রভাবে মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যাদুর প্রভাবে স্বামীস্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। (এরপর ইবনে ক্বুদামা রহ. তাঁর কথার স্বপক্ষে কোরআন হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দেন) [আল মুগনী, ১০/১০৬ দ্রষ্টব্য]
৪. ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন- সুরা ফালাক্বের ওয়া মিন শাররিন্নাফফাসাতি… আয়াত এবং আয়েশা রা, এর হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয় যাদু নিঃসন্দেহে সত্য। [বাদাইউল ফাওয়ায়েদ, ২/২২৭]
৫. ইমাম রাযি রহ. তো যাদুর ৭ রকম ভাগ করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, ইবনে কাসির রহ. সেটা উদ্ধৃত করে পর্যালোচনা করেছেন। [তাফসিরে ইবনে কাসির, সুরা বাক্বারা ১০২-৩ আয়াতের আলোচনা দ্রষ্টব্য]
৬. ইমাম রাগেব ইস্পাহানী রহ. যাদুকে ৪ ভাগে ভাগ করে ব্যাখ্যা করেছেন। [আল মুফরাদাত, س-ح-ر মাদ্দা দ্রষ্টব্য]
মানুষের ওপর যাদু কিভাবে করা হয়?
যাদুর অনেক ধরণ আছে, একেকটা একেকভাবে করা হয়। মানুষের ক্ষতি করার জন্য সমাজে প্রচলিত যাদুকে প্রাথমিকভাবে আমরা দুইভাগে ভাগ করবো- ১. যেসব যাদুতে শয়তান পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে। ২. যেসব যাদুর জন্য জিন-শয়তানদের কাছে সরাসরি সাহায্য চাওয়া হয়।
কর্মপদ্ধতির দিক থেকে চারভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১. যাকে যাদু করা হবে তাঁর ব্যবহৃত কোনো জিনিশ / কাপড় অথবা শরীরের কোন অংশ যেমন: চুল, নখ ইত্যাদি কোনো গাছের ডাল, ভুডু ডল বা এরকম কিছুতে রেখে যাদু করা হয়
২. কখনো যাদুকর নিজে পারেনা, তখন জিন দিয়ে যাদু করায়
৩. কখনো নিজে যাদু করে, সাথে জিনও পাঠায় ক্ষতি করার জন্য
৪. কখনো ব্যবহারের জিনিশ না পেলে মন্ত্র পড়া পানি বাড়ির সামনে ফেলে যায়, ওর ওপর দিয়ে হেটে গেলে যাদু লেগে যায়।
আলতুফালতু সিনেমা নাটক আর আলিফ লায়লা দেখে দেখে মানুষ ধারণা করে যাদু আলাদিনের চেরাগের মত। ঘষা দিয়ে, যা ইচ্ছা বলল। আর হয়ে গেল। বাস্তবে যাদুর জন্য অনেক সেক্রিফাইস করতে হয়, অনেক ঝামেলা আছে। যাদু হচ্ছে মূলত: প্রকৃতির নিয়ম ওলটপালট করা। আর ব্যাপারটা মোটেও সোজা না।
উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প তো এমনিতেই পাগল, আপনি চাইলেই যাদু করে ট্রাম্পকে একদম পাগল বানাতে পারেন না। এজন্য ট্রাম্পের মাথার চুল অথবা মাথার ঘাম লাগানো কোনো কাপড় লাগবে, অথবা যাদুর জিনিশের গন্ধ ট্রাম্পের ব্রেইনে পৌঁছানো লাগবে। এরসাথে যে যাদু করবে তাকে শয়তানের নিয়ম মত সেক্রিফাইস করতে হবে। শয়তান সন্তুষ্ট না হলে যাদু হবে না।
সতর্কতাঃ
১. উল্লেখিত প্রথম কারণে কোনো কবিরাজের কাছে চিকিৎসা করতে গেলে যদি আপনার কাপড় চায়, ভুলেও দিবেন না।
২. বাড়িতে মেহমান এসেছিল, কদিন পর হটাত খেয়াল করলেন কোনো কাপড়ের কোনা কাটা! সাথে-সাথে সাবধান হয়ে যান, মাসনুন আমলে গুরুত্ব বাড়িয়ে দিন, সমস্যার সন্দেহ হলে রুকইয়া করুন।
৩. উল্লেখিত দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কারণে সিহরের জন্য রুকইয়া করতে লাগলে কখনো রুগীর ওপর জিন চলে আসে। এজন্য রাক্বির মানসিক প্রস্তুতি থাকা জরুরী। (বিস্তারিত পরে বলা হবে ইনশাআল্লাহ)
সিহরের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতাঃ
১. কারো ওপর এক সাথে একাধিক যাদু করতে পারে, তখন সবরের সাথে একটা একটা করে চিকিৎসা করতে হবে।
২. একবার রুকইয়া করেছেন, অথবা যাদুর ট্রিটমেন্ট করার পর ভালো হয়ে গেছে। যে যাদু করেছে জানলে আবার যাদু করতে পারে। এজন্য উত্তম হচ্ছে, এসব বিষয়ে যারতার সাথে গল্প করে দ্বিতীয়বার বিপদ না ডেকে আনা।
৩. কোনো কোনো কবিরাজের কাছে চিকিৎসা করতে গেলে জোরে জোরে কোরআনের আয়াত পড়ে, আর আস্তে আস্তে মন্ত্র পড়ে। কেউ কেউ প্রতিদিন দোয়া-কালাম লেখা কাগজ পুড়াতে বলে। এদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
৪. যাদু দিয়ে যাদুর ট্রিটমেন্ট করানো – করা দুইটাই গুনাহ, মন্ত্রে কোনো কুফরি বাক্য থাকলে তো স্পষ্ট কুফরি। চাই সেটা ভালো কাজে ব্যবহার হোক অথবা খারাপ কাজে।
৫. বাস্তবতা হচ্ছে, যেসব কবিরাজ যাদু-টোনা করে ওদের কাছে চিকিৎসা করিয়ে একটা সমস্যা ভালো হলে আরো নতুন সমস্যা তৈরি হয়। অনেকে তো এমন, আগেরবার চিকিৎসার নামে অনেক টাকা ফেঁড়েছে, আবার যেন তাঁর কাছে আসে, এজন্য কবিরাজ-ই যাদু করে।
৬. তাই সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে, শুধু কোরআনের আয়াত এবং রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত কোনো কোনো দু’আ দিয়ে যাদুর জন্য রুকইয়া করা। ভণ্ড কবিরাজদের থেকে দূরে থাকা।
৭. কোনো হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য চিকিৎসা করলেও, কোরআন বা দোয়ায়ে মাসুর দিয়েই করতে হবে। কোরআন সবার ওপরেই প্রভাব ফেলে।
মন্তব্য করুন