Ruqyah Support BD

যাদু সম্পর্কে ইসলামী আক্বিদা, কুরআন-হাদীসের বর্ণনা : যাদুগ্রস্ত ১

বিসমিল্লাহ। রুকইয়াহ শারিয়্যাহ সিরিজের তৃতীয় অধ্যায়; তথা ব্ল্যাক ম্যাজিক সিরিজ শুরু হল। শুরুতে কিছু বিষয় বলে রাখলে পাঠক লেখক সবারই ফায়দা হবে।

প্রথমত: যাদুর অনেক শাখাপ্রশাখা রয়েছে, কোরআন হাদিস তাফসির তারিখে যাদু বিষয়ে অনেক অনেক আলোচনা আছে। যাদু শাস্ত্রের সব বিষয় এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয়, যাদুটোনা করে কারো ক্ষতি করলে, ইসলাম সমর্থিত পদ্ধতিতে এর প্রতিকার কি হবে। ইনশাআল্লাহ এখানে আমরা ১০-১২ প্রকারের যাদুর ট্রিটমেন্ট আলোচনা করবো।

দ্বিতীয়ত: এই সিরিজে চিকিৎসার এমন সব পদ্ধতি আলোচনা করা হবে যেগুলোকে ইসলাম বৈধ বলে। তবে এটা মনে করার অবকাশ নেই, শুধুমাত্র এই একটা পদ্ধতিই জায়েজ। বরং একাধিক জায়েজ পদ্ধতি থাকতে পারে। রুকইয়াহ শারইয়্যার শরঈ বিধান নিয়ে আগেও আমরা আলোচনা করেছি, আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।
বরাবরের মতই প্রথমে আমাদের আলোচ্য বিষয়ে ইসলামী আক্বিদা জানবো। কোরআন, হাদিস এবং সালাফের দৃষ্টিতে এর মূল্যায়ন দেখবো, এরপর অন্য প্রসঙ্গে যাবো।

কোরআনুল কারিমের অনেক যায়গায় যাদুর কথা রয়েছে। অন্তত ৩-৪প্রকারের যাদুর কথা বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে ৫০এরও বেশি স্থানে! এর মাঝে অধিকাংশ আয়াতে এরকম এসেছে, কোনো নবী কওমের কাছে দাওয়াত নিয়ে গেছেন, আর তাঁরা নবীর ওপর যাদুকর হওয়ার অপবাদ দিয়েছে, অথবা বলেছে তোমাকে কেউ যাদু করেছে তাই তুমি এসব বকছো!(নাউযুবিল্লাহ)

এথেকে বুঝা যায়, মানব সভ্যতার শুরু থেকেই যাদু একটি ঘৃণিত বিষয়; একটি অভিশপ্ত শাস্ত্র! দেখুন আল্লাহ তা’আলা কি বলছেন-

১. “এমনিভাবেই তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোন রসূল এসেছে,তারা বলেছেঃ যাদুকর, না হয় উম্মাদ!” (সুরা যারিয়াত, আয়াত ৫৬)

২. “যদি আমি ওদের সামনে আকাশের কোন দরজাও খুলে দেই আর তাতে ওরা দিনভর আরোহণ ও করতে থাকে। তবুও ওরা একথাই বলবে যে, আমাদের চোখ ভুল দেখছে? না আমরা যাদু আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। (সুরা হিজর, ১৫)

এই আয়াত দিয়ে এক ভাই সেদিন ওয়ার্মহোলের দিকে ইংগিত দিচ্ছিলেন। হতে পারে, আল্লাহ মালুম! তবে যাইহোক না কেন, যাদু দ্বারা এমন অস্বাভাবিক কাজ করা যায়, যা বাহ্যদৃষ্টে অবিশ্বাস্য; এটা এই আয়াত থেকে স্পষ্টই বুঝা যায়। আয়াতটি আরেকবার দেখে নিন।

এরপর মুসা আ. এর ঘটনা বিভিন্ন সুরায় এসেছে, যেমনঃ সুরা আরাফ, সুরা ইউনুস, সুরা ত্বাহা। সুরা আ’রাফের একটি আয়াত দেখুন-

৩.তিনি (মুসা আ.) বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ কর। যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন তাদের যাদু লোকদের চোখগুলোকে ধাঁধিয়ে দিল, ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল এবং তাঁরা বিরাট যাদু প্রদর্শন করল। তারপর আমি মূসাকে ওহী পাঠালাম, তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। এরপর, যাদু দিয়ে তারা যা বানিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে সেটি (লাঠি) সবকিছু গিলতে লাগল।” (সুরা আরাফ, ১১৫, ১১৬)

আমাদের রাসুল স. এর ওপরেও যাদু করা / বান মারা হয়েছিলো। তখন আল্লাহ দুয়া শিখিয়ে দিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে-

৪.বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে, আর অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়, এবং গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিনীদের অনিষ্ট থেকে” (সুরা ফালাক, ১-৪)

রাসুল ﷺ এর ওপর যাদু করার কারণে তিনি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যাদু দ্বারা মানুষের ক্ষতি করা যায় তাঁ অন্য আরেক আয়াতেও স্পষ্ট বুঝা যায়, খেয়াল করুন-

৫.অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন যাদু শিখত, যদ্দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তদ্দ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না” (সুরা বাকারা, ১০২ আয়াতের অংশ)

এই আয়াত নিয়ে মুফাসসিরিনে কিরাম অনেক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। লম্বাচওড়া তাফসির দেখতে চাইলে আগ্রহীদের জন্য বয়ানুল কোরআন এবং তাফসিরে ইবনে কাসির রয়েছে, আর সংক্ষিপ্ত আলোচনার তাওযিহুল কোরআন অথবা মা’রিফুল কোরআন তো আছেই।

তবে যাদু সম্পর্কে অধিকাংশের ধারণা হচ্ছে এটা আলাদীনের চেরাগের মত! ঘষা দিলেই যা খুশি পাওয়া যায়। সিনেমা নাটক আর আলি লায়লার গাঁজাখুরি গল্প দেখে এই আজগুবি ধারনা জন্ম নিসে। এই ধারণা অনেক বড় ভুল, বরং যাদুর জন্য অনেক কিছু সেক্রিফাইস করতে হয়, আর চাইলেই সব পাওয়া যায়না। এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।

এখানে সংক্ষেপে একটা আক্বিদা না বললেই নয়, ‘যাদুর শক্তি ইনভিজিবল, কিভাবে দড়ি দিয়ে সাপ বানিয়ে ফেললো তা আমাদের বোধগম্য নয়। তারমানে এটা না, যাদুর নিজস্ব ক্ষমতা আছে। বরং আর দশটা শক্তির মত যাদুও ঐশ্বরিক শক্তির ওপরেই নির্ভরশীল।’ খেয়াল করুন উপরোল্লেখিত আয়াতেই আল্লাহ বলেছেন! “আল্লাহ না চাইলে যাদু দিয়ে তারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না”

কোরআনে যাদু বিষয়ে এত বেশি আলোচনা আছে, আক্বিদা বয়ানের জন্য এরপর অন্য কোনো রেফারেন্সের প্রয়োজনই থাকেনা। তবুও আমরা কিছু হাদিস দেখবো।

১. হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সাতটি ধ্বংসকারী জিনিস থেকে দূরে থাকো। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! সে জিনিসগুলো কি? তিনি বললেনঃ আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরীক করা, যাদু বিদ্যা শেখা ও তার চর্চা করা, যে জীবনকে হত্যা করা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন, তাকে অবৈধভাবে হত্যা করা, সূদী লেনদেন করা, ইয়াতীমের ধন আত্মসাৎ করা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া, পবিত্র চরিত্রের অধিকারী মুমিন নারীর ওপর অপবাদ দেয়া। (বুখারী, মুসলিম)

২. আবু বাকর ইবন আবি শায়বা রহ. সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে সাতটি করে আজওয়া খেজুর (মদীনা শরীফে উৎপন্ন এক জাতীয় উৎকৃষ্ট মানের খেজুর) আহার করে, সেদিন তাকে কোন বিষ বা যাদু ক্ষতি করতে পারে না । (মুসলিম)

৩. এরপর রাসুল স.কে যাদু করার ব্যপারে বুখারীর দীর্ঘ হাদিসটি তো আছেই, হাদিসের সারকথা এরকম “আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, লাবীদ ইবনে আসাম নামক এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে যাদু করে। একরাত্রে রাসুল স. বারবার দু‘আ করতে থাকেন। তারপর তিনি বলেনঃ হে ‘আয়েশা! তুমি কি বুঝতে পেরেছ, আমি আল্লাহর কাছে যা জানতে চেয়েছিলাম, তিনি আমাকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। আমার নিকট দু’জন লোক এসেছিলো। তাদের একজন আমার মাথার কাছে এবং অপরজন দু‘পায়ের কাছে বসেন। একজন জিজ্ঞেস করলোঃ এ লোকটির কি ব্যথা? আরেকজন বললো, যাদু করা হয়েছে। প্রথমজন বলেনঃ কে যাদু করেছে? দ্বিতীয়জন বলেনঃ লাবীদ ইন আ‘সাম। প্রথমজন জিজ্ঞাসা করেনঃ কি দিয়ে? দ্বিতীয়জন উত্তর দেনঃ চিরুনী, মাথা আচড়ানোর সময় উঠা চুল এবং পুরুষ খেজুর গাছের খোসার মাধ্যমে….” (বুখারিতে বর্ণিত এই হাদিসটি বেশ দীর্ঘ)

৪. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জ্যোতিষ বিদ্যার কিছু শিক্ষা করলো, সে যেন যাদু বিদ্যার একটা শাখা আয়ত্ত করলো, এখন তা যত বাড়ায় বাড়াক। (আহমাদ, আবূ দাউদ)

৫. ইমরান বিন হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল স. বলেছেন- যে কুলক্ষণ নির্ণয় করে, আর যার জন্য নির্ণয় করা হয়।যে যাদু করে,আর যার জন্য যাদু করা হয়। এবং যে গণকের নিকট এলো এবং তাঁর কথা বিশ্বাস করলো..। এরা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মুসনাদে বাযযার, সনদ হাসান)

এই হাদিস অনুযায়ী যাদুকর, গণক, ট্যারট কার্ড ওয়ালা সবাই কুফরি করছে। এবং তাদের কাছে যারা যাচ্ছে, হেল্প চাচ্ছে তারাও। আসুন আমরা সতর্ক হই। 

এরকম অনেক হাদিস রয়েছে, সব উল্লেখ করা তো সম্ভব না। তবে ইসলাম যাদুর অস্তিত্ব স্বীকার করে কিনা, আশা করছি এব্যাপারে আর কারো দ্বিমত নেই।

পরের পর্ব >>

মন্তব্য করুন