লিখেছেনঃ উম্মে আব্দুল্লাহ
বর্তমানে খুবই কমন একটা প্রশ্ন, “প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কি রুকইয়া করা যায়?? কী রুকইয়াহ করবো??
এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পুর্বে আমার মনে হয় গর্ভকালীন সময়ে একজন গর্ভবতী নারীর হরমোনাল পরিবর্তনের কারনে যে শারীরিক, মানসিক পরিবর্তন আসে সেই বিষয়ে কিছু বলা দরকার। এ সময় যে কমন সমস্যাগুলো দেখা যায় তার মধ্যে-
মর্নিং সিকনেস, বমি বমি ভাব, পা ও পিঠে ব্যথা, কোমর ব্যথা, বুক জ্বালাপোড়া করা, ঘুম না হওয়া, অস্থিরতা, বিষণ্ণতা, মাথা ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, কখনো খাবারে অরুচি আবার কখনওবা খুব বেশি ক্ষুধা পাওয়া, পেট খারাপ হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, পা ফুলে যাওয়া, কখনো কখনো শ্বাসপ্রশ্বাসেও কষ্ট হয়। এছাড়া ঘুমের সমস্যার কারনে বুক ধড়ফড় ও দুঃস্বপ্নও দেখেন অনেকেই। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত রাগ, বিরক্তবোধ, একা থাকতে ভালো লাগাসহ নানা ধরনের পরিবর্তন আসে।
এগুলোকে অনেকে অস্বাভাবিক মনে করে ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ, তেল পড়া, পানি পড়া, গাছের শিকড় ইত্যাদি নেয়াসহ অনেকধরনের তদবীর করে থাকেন।। যা অপ্রয়োজনীয় আর এসবের অধিকাংশই হয় ভিত্তিহীন। গর্ভাবস্থায় কম-বেশি সবাই এসব সমস্যা ফেইস করেন। তাই এইগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে স্বাভাবিকভাবে নেবার চেষ্টা করুন। চেষ্টা করুন স্বাভাবিক থাকার, আর নিয়মমাফিক চলার। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খান, পুষ্টিকর খাবার খান, পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুমান। আর হ্যাঁ সম্ভব হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সে মোতাবেক চলার চেষ্টা করুন। ভালো থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
এতো গেলো শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনের কথা। এবার আসি প্যারানরমাল সমস্যার দিকে। এ সময়টা অনেকেই সাপ, বিচ্ছু, বিভিন্ন পোকামাকড়সহ নানা জীব-জন্তু স্বপ্নে দেখেন। অনেক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন।। মনে হয় ওইটা স্বপ্ন না বাস্তবেই ঘটেছে।।
এক্ষেত্রে প্রথম কথা হচ্ছে, আপনি যাই দেখুন না কেন, স্বপ্নের কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন না। একান্তই যদি মনে চলে আসে তাহলে ভালো কিছু ভাববেন। খারাপ স্বপ্ন দেখলে স্বপ্নের খারাবি থেকে বাঁচার জন্য দুয়া করবেন। মনে রাখবেন শয়তান আপনাকে অমুলক ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। আপনি ওদের সুযোগ দিবেন না। তাছাড়া ওদের কোনই ক্ষমতা নাই, আর রব্বুল আ’লামীনের ইচ্ছা ছাড়া কোন কিছুই ঘটবে না। তাই বেশি বেশি দু’আ করুন। তাঁর কাছেই সাহায্য চান।একটি হাদিস আছে এরকম-
আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবি কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ভাল ও সুন্দর স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। যদি কেউ ভাল স্বপ্ন দেখে তাহলে তা শুধু তাকেই বলবে যে তাকে ভালোবাসে। অন্য কাউকে বলবে না। আর যদি স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখে তাহলে শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। (এরকম বলা যায়, আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম) এবং বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করবে। আর কারো কাছে স্বপ্নের কথা বলবে না। মনে রাখবে এ স্বপ্ন তার ক্ষতি করতে পারবে না।(বুখারি ও মুসলিম)অনেকে বলেন, আমি এই স্বপ্ন দেখেছি তাই এইটা হয়েছে! অমুক এই স্বপ্ন দেখেছেন এরপর এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। যেইটা একেবারেই অমুলক। বরং আপনি খারাপ অর্থ দাঁড় করিয়েছিলেন বলেই হয়তো এমনটা ঘটেছে। তাই আবারো বলছি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন না। তবে হ্যাঁ পুর্বে জ্বীন-যাদুজনিত সমস্যা থাকলে এ সময় সমস্যা কিছুটা বাড়তে পারে। এক্ষেত্রেও ভয়ের কিছু নাই। মাসনুন আমলগুলো গুরুত্বসহকারে করতে থাকুন।
তবে যদি বাচ্চা নষ্ট করার যাদু করা হয় তাহলে এ থেকে বাঁচার জন্য রুকইয়াহ করতে পারেন। অবশ্যই তা গুরুত্বের সাথে। যদি নিশ্চিত থাকেন ঠিকঠাকমত রুকইয়াহ করতে পারবেন তাহলে আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করে শুরু করতে পারেন।আব্দুল্লাহ তার উস্তায মুহাম্মাদ তিম হাম্বলকে একবার প্রেগন্যান্সিতে রুকইয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি বলেছিলেন- আমি হলে এরকম পরিস্থিতিতে একান্ত আবশ্যক না হলে ঝুঁকি নিতে যাব না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রুকইয়াহ না করে বিভিন্ন খারাপ জিনিসের ক্ষতি থেকে কিভাবে বাঁচবো??
- সময়মত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করুন। সম্ভব হলে নফল ইবাদাত করুন বেশি বেশি। চেষ্টা করুন তাহাজ্জুদ মিস না দেয়ার। সাথে সালাতুল হাজতও পড়ার চেষ্টা করুন।
- চেষ্টা করুন নিজের জবানকে যিকরে অভ্যস্ত করার। শুয়ে, বসে সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরনে মশগুল থাকুন। অন্তরে প্রশান্তি আসবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন____“ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ ٱللَّهِۗ أَلَا بِذِكْرِ ٱللَّهِ تَطْمَئِنُّ ٱلْقُلُوبُতারাই ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রেখ, আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমেই দিলের সত্যিকারের প্রশান্তি লাভ করা যায়। (সূরা রাদ: ২৮)
- গুনাহ থেকে বাঁচুন। বিশেষ করে মেয়েদের দ্বারা যে সহজ কিন্তু ভয়ংকর গুনাহগুলো সংঘটিত হয় সেগুলো থেকে বাঁচুন। একে অন্যের দোষচর্চা, সিরিয়ালপ্রীতি, পর্দা সম্পর্কে উদাসীনতা, অপ্রয়োজনে বাইরে যাওয়া এসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করুন।
- বেশি বেশি ইস্তেগফার করুন, দরুদপাঠ করুন। তিন তাসবীহসহ প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য নির্দিষ্ট তাসবীহ সমুহ আদায় করুন।
- ওযু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করুন। বিশেষ করে ঘুমাতে যাবার আগে ওযু করে নিন।
- নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বলেন,”যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন নামাজের মত করে ওযু করে নিবে।” (মুসলিম : ৪৮৮৪)
- সকাল সন্ধ্যা এবং ঘুমের আগের মাসনুন আমলগুলো গুরুত্বের সাথে করুন। বিশেষতঃ তিন কুলের আমল মিস দিবেন না।
- সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস পড়ুন। আর ঘুমের আগে তিনবার পড়ে হাতে ফুঁ দিয়ে পুরো শরীরে বুলিয়ে নিন। আর আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাবেন। আব্দুল্লাহ ইবনু খুবাইব রা. থেকে বর্ণিত, নবি ﷺ বলেছেন, ‘কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ এবং ‘মুয়াওয়াযাতাইন’ সকালে ও সন্ধ্যায়—তিন বার বল। এটা সব কিছু থেকে তোমার হেফাজতের জন্য যথেষ্ট হবে। (তিরমিযী, আবু দাউদ)
- ফজর এবং আসরের পর অবশ্যই “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া’হদাহু লা-শারীকালাহ, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল ‘হামদ, ওয়াহুওয়া ‘আলা- কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর” এটা ১০০বার পড়া। কোনোদিন না পারলে অন্তত ১০বার পড়বেন।
- কুর’আন তিলাওয়াত করুন। কুর’আনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করুন। এখন অনেকে বলেন কি সুরা পড়বো?? কুর’আন হাদীসে নির্দিষ্ট সুরার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
তবে অনেক বুজুর্গ এসব সুরা বেশি বেশি পড়তে বলেছেনঃ
♦প্রথম মাসে- সুরা আল-ইমরান।
♦দ্বিতীয় মাসে-সূরা ইউসুফ।
♦তৃতীয় মাসে-সূরা মারিয়াম।
♦চতুর্থ মাসে-সূরা লোকমান।
♦পঞ্চম মাসে-সূরা মুহাম্মদ।
♦ষষ্ঠ মাসে- সূরা ইয়াসীন।
♦সপ্তম, অষ্টম,নবম ও দশম মাসে-সূরা ইউসুফ, মুহাম্মদ ও ইব্রাহীম।
এছাড়া এমনতেই খতমের নিয়াতেও কুর’আন পড়তে পারেন, এই লম্বা সময়ে চেষ্টা করলে অনেকবার খতম দেয়া সম্ভব।।
এ সময় সবর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় একজন গর্ভবতী মাকে নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এক্ষেত্রে সবর করলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এছাড়া বেশি বেশি দু’আ করুন। মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন, পজিটিভ থাকুন। নিজের সমস্যার কথা পরিবারের সাথে শেয়ার করুন।। আবারো বলছি মাসনুন আমলগুলো বাদ দিবেন না। যদি ভুলে যান ইয়াদ হওয়ার সাথে সাথে পড়ে নিবেন।। আর যদি কোন সময় সমস্যা বুঝতে পারেন, তাহলে তখন তিনকুল পড়ে শরীর মুছে নিবেন।
এগুলো মেনে চললে নানা রকম বালা মুসিবত থেকে রক্ষা পাবেন আর রব্বুল আ’লামীনের নৈকট্যও অর্জনেও সহায়ক হবে। (ইনশাআল্লাহ)
আর সবশেষে বললেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি হল, দোয়া। অবশ্যই অবশ্যই দোয়া করবেন, নিজের জন্য, সন্তানের জন্য দিল খুলে দোয়া করবেন। যা চান, যেমন চান সব আল্লাহর কাছে বলবেন।
আল্লাহ আমাদের বুঝার এবং মানার তাওফিক দিন। আমিন!
মন্তব্য করুন