আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ। প্রথম বিষয় হচ্ছে, কোনো বাড়িতে যদি জ্বিনের উৎপাত থাকে, তাহলে তাড়াবেন কিভাবে?
এর বেশ কয়েকটি বৈধ পদ্ধতি আছে, সবগুলোই কমবেশি ফলপ্রসূ।
প্রথম পদ্ধতি: আপনি আরো দুজন লোক সাথে নিয়ে ওই বাড়িতে যাবেন, তারপর জোরে জোরে কয়েকবার বলবেনঃ
أُنَاشِدُكُمْ بِالْعَهْدِ الَّذِيْ أَخَذَهُ عَلَيْكُمْ سُلَيْمَانَ أَنْ تَرْحَلُوْا وَتَخْرُجُوْا مِنْ بَيْتِنَا أُنَاشِدُكُمُ اللّٰهُ أَنْ تَخْرُجُوْا وَلَا تُؤْذُوْا أحَدًا
অর্থাৎ: “আমি তোমাদের সেই ওয়াদার জন্য আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি, যে ওয়াদা সুলাইমান আ. তোমাদের থেকে নিয়েছেন। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমরা বের হয়ে যাও এবং কারো ক্ষতি করো না।”
পরপর তিনদিন এরকম করবেন, আরবিও বলবেন, বাংলাও বলবেন। ইনশাআল্লাহ! জ্বিনেরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এরপরেও যদি কোনো সমস্যা টের পান, তাহলে দ্বিতীয় পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
দ্বিতীয় পদ্ধতি: একটা বড় পাত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি নিন, এরপর পানির কাছে মুখ নিয়ে নিচের দু’আটি পড়ুন-
بِسْمِ اللّٰهِ ، اَمْسِيْنَا بِا للّٰهِ الَّذِيْ لَيْسَ مِنْهُ شَيْءٌ مُمْتَنِعٌ ، وَبِعِزَّةِ اللّٰهِ الَّتِيْ لَا تُرَامُ وَلَا تُضَامُ، وَبِسُلْطَانِ اللّٰهِ الْمُنِيْعِ نَحْتَجِبُ، وَبِأَسْمَائِهِ الْحُسْنٰى كُلِّهَا عَائِذٌ مِّنَ الْأَبَالِسَةِ ، وَمِنْ شَرِّ شَيَاطِيِنِ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ ، وَمِنْ شَرِّ كُلَّ مُعْلِنٌ اَوْ مُسِرٌّ ، وَمِنْ شَرِّ مَا يَخْرُجُ بِاللَّيْلِ وَيَكْمُنُ بِالنَّهَارِ ، ويَكْمُنُ بِاللَّيْلِ و يَخْرُجُ بِالنَّهَارِ ، وَمِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ وَذَرَأَ وَبَرَأَ ، وَمِنْ شَرِّ اِبْلِيْسِ وَجُنُوْدِهِ ، وَمِنْ شَرِّ دَابَّةٍ اَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا إِنَّ رَبِّيْ عَلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ ، اَعُوْ بِمَا اسْتَعَاذَ بِهٖ مُوْسٰى ، وَعِيْسٰى ، وَاِبْرَاهِيْمَ الَّذِيْ وَفّٰى ، وَمِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ وَذَرَأَ وَبَرَأَ ، وَمِنْ شَرِّ اِبْلِيْسِ وَجُنُوْدِهِ ، وَمِنْ شَرِّ مَا يَبْغٰي
এরপর আউযুবিল্লাহ বিসমিল্লাহ সহ (২৩ পারায়) সুরা সফফাত এর প্রথম ১০ আয়াত পড়ুন,
اعوذ بالله من الشيطن الرجيم – بسم الله الرحمن الرحيم
وَالصَّافَّاتِ صَفًّا (1) فَالزَّاجِرَاتِ زَجْرًا (2) فَالتَّالِيَاتِ ذِكْرًا (3) إِنَّ إِلَهَكُمْ لَوَاحِدٌ (4) رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَرَبُّ الْمَشَارِقِ (5) إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةٍ الْكَوَاكِبِ (6) وَحِفْظًا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَارِدٍ (7) لَا يَسَّمَّعُونَ إِلَى الْمَلَإِ الْأَعْلَى وَيُقْذَفُونَ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ (8) دُحُورًا وَلَهُمْ عَذَابٌ وَاصِبٌ (9) إِلَّا مَنْ خَطِفَ الْخَطْفَةَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ ثَاقِبٌ (10)
সব পড়ে পানিতে ফুঁ দিবেন। এবং ওই পানি পুরো বাড়ীতে ছিটিয়ে দিবেন। ইনশাআল্লাহ আর কোনো সমস্যা থাকবে না। বাড়িতে দুষ্ট জ্বিন থাকলে চলে যাবে।
(উপরিউক্ত পদ্ধতি ইবনুল কায়্যিম রহ. উনার ﺍﻟﻮﺍﺑﻞ ﺍﻟﺼﻴﺐ ﻓﻲ ﺍﻟﻜﻠﻢ ﺍﻟﻄﻴﺐ কিতাবে বর্ণনা করেছেন, বিন বায রহ. থেকেও এই আলোচনা পাওয়া যায়। আমার মনে হয়, উপরের পদ্ধতি অনুসরণ করে পানি ছিটানোর পর একবার আযান দেয়া উত্তম)
তৃতীয় (সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তি) পদ্ধতি:
এটা গত ২রা মার্চ মুন্সিগঞ্জের মাহফিলে সাইয়্যেদ আসজাদ মাদানী দা.বা. বয়ান করেছেন। কোনো বাড়িতে জ্বিনের উৎপাত থাকলে সেই বাড়িতে পরপর তিনদিন সুরা বাক্বারা তিলাওয়াত করতে হবে। আর নতুন বাড়ি করার পর যদি পরপর তিনদিন সুরা বাক্বারা তিলাওয়াত করা হয়, তাহলে আগে থেকে কোনো জ্বিন বা অন্য ক্ষতিকর মাখলুক থাকলে চলে যাবে। এর সমর্থনে হাদিসও আছে।
তো, এই হচ্ছে বাড়ি থেকে খবিস জ্বিন তাড়ানোর সমাধান। তবে এসব করার পরে আর যেন সমস্যা না হয়, এজন্য কিছু বিষয় খেয়াল রাখবেনঃ
১. বাড়িতে ইসলামী পরিবেশ চালু রাখার চেষ্টা করা, বিশেষতঃ কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য বা ছবি যেন ঘরে টাঙানো না থাকে। রাসুল সা. বলেছেন যে ঘরে কুকুর বা জীবজন্তুর ছবি থাকে, সেখানে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।
২. আর নফল – সুন্নাত নামাজ সম্ভব হলে ঘরে পড়বেন। আহলিয়া থাকলে বলবেন, যে ঘরে সবসময় নামাজ পড়া হয়, সেটা বাদে অন্যান্য ঘরেও যেন মাঝেমাঝে পড়ে।
৩. সম্ভব হলে প্রতিমাসে ১-২বার সুরা বাক্বারা পড়া।
৪. বিসমিল্লাহ বলে বাড়িতে প্রবেশ করা, বিসমিল্লাহ বলে দরজা – জানালা বন্ধ করা।
৫. টয়লেটের দরজা বন্ধ রাখা।
আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন, আ-মীন।
[খ]
কোনো জ্বিনে ধরা রুগীর চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো ব্যাপার থাকে, যেসব চিকিৎসককে খেয়াল রাখতে হয়। প্রথমত: উপস্থিত বুদ্ধি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাহোক, এখন আমরা জানবো যিনি চিকিৎসা করবেন তার কি কি গুন থাকা উচিত-
১. আকিদা বিশুদ্ধ হওয়া, শিরক-বিদআতমুক্ত পরিচ্ছন্ন ইসলামী আক্বিদার অনুসারী হওয়া।
২. মৌলিক ইবাদাতগুলো তথা নামাজ-কালাম, মাহরাম-গাইরে মাহরাম এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া। হালাল-হারামের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া, হারাম থেকে বেঁচে থাকা।
৩. অধিক পরিমাণে জিকির-আজকার, রোজা, তাহাজ্জুদ ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মিকভাবে দৃঢ় হওয়া।
৪. আল্লাহর কালাম যে জ্বিন-শয়তানের ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম, এব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস (ইয়াক্বীন) রাখা।
৫. জ্বিন জাতির অবস্থা তথা: প্রকারভেদ, জাতপাত, কাজকর্ম, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কিভাবে মানুষের ওপর আসর করে, কিভাবে কিভাবে বের হয়… ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত থাকা।
৬. জ্বিনদের মাঝে মিথ্যা বলার প্রবণতা খুবই বেশি! এজন্য জ্বিনদের স্বভাব, ধোঁকাবাজি, কূটকৌশলের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। (যেমন: দ্বিতীয় পর্বে বলা ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ঘটনায়… জ্বিন বলেছিল আপনার কথা মেনে চলে যাচ্ছি। ইবনে তাইমিয়া রহ. বললেন, না! তুমি আল্লাহ এবং রাসুল স. এর আনুগত্য করে চলে যাও। এখানে উনি এই কথা না বললে সম্ভাবনা ছিল, হয়তো উনার মৃত্যুর পর আবার জ্বিন ফিরে আসতো। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের ঘটনায় যেমনটা আমরা দেখেছি!)
৭. রাসুল সা. এর শিখিয়ে দেয়া দু’আগুলো যেমন: ঘরে – মসজিদে ঢোকার দোয়া, বের হওয়ার দোয়া, কুকুর ডাকতে শুনলে দোয়া (আ’উযুবিল্লাহ পড়তে হয়) কাক ডাকতে শুনলে দোয়া, টয়লেটে ঢোকার-বের হবার দোয়া, এসবের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া। এজন্য বিশুদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থের সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
৮. নিজের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা। কারণ, আপনি নিজেই দুর্বল হলে অন্যের ওপর ভর করা শয়তানকে শায়েস্তা করবেন কিভাবে? এজন্য খারাপ জ্বিন-শয়তান থেকে বাঁচার জন্য যা যা করনীয় আছে, সেসব গুরুত্ব সহকারে করা। (এক শায়খের ঘটনা আগেও বলা হয়েছে। জ্বিন ছাড়ানোর সময় উনার ওপরেই আসর করার চেষ্টা করেছিলো জ্বিন, কিন্তু সকালে দুয়া পড়ার কারণে পারেনি)
৯. আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জ্বিন ছাড়াতে গিয়ে কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী অবৈধ কোনো পন্থার অনুসরণ না করা। সম্পূর্ণ আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল (ভরসা) রাখা। যে, আল্লাহ অবশ্যই এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। সমস্যার সমাধান করবেন।
১০. চিকিৎসক ব্যক্তি বিবাহিত পুরুষ হওয়া উচিত। আবশ্যক নয়, তবে হলে ভাল হয়।
আর হ্যাঁ! সমস্যা সমাধানে চিকিৎসককে অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে, মনে রাখবেন এটাও একটা রোগ। শারিরীক না হলেও আত্মীক রোগ।
যাহোক, এই বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন।
[গ]
কেউ যদি এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে চায় তাহলে তার জন্য সাজেস্টেড কিছু বই এর নাম-
১. ইমাম সুয়ুতি রহ.-এর লাক্বতুল মারজান ফি আহকামিল জান (আরবির চেয়ে বাংলা জ্বিন জাতির ইতিহাস বেশি ভালো)
২. ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর রিসালাতুল জ্বিন
৩. ইমাম নববী রহ. এর শরাহ সাথে রেখে মুসলিম শরিফের “কিতাবুত ত্বীব / চিকিৎসা অধ্যায়” দেখা যায়
৪. বুখারীর “বাদাউল খলক/ সৃষ্টির সূচনা” অধ্যায় দেখতে পারেন, সাথে ফাতহুল বারি রাখলে আরো ভালো
৪. ইবনে কাসির রহ. উনার তাফসীরে কিছু আলোচনা করেছেন এবিষয়ে
৬. আ-কাম আল মারজান ফি গারাইবিল জান, লেখক: বদরুদ্দিন শিবলী হানাফী রহ.
৭. তালবীসে ইবলিস, লেখক: ইবনুল জাওযি রহ.
৮. উই/ওয়াকায়াতুল ইনসান মিনাল জিন্নি ওয়াশ শাইত্বন, লেখক: শাইখ ওয়াহিদ বিন আব্দুস সালাম
৯. ইগাসাতুল লাহফান মিন মাসাইদিশ শাইত্বন, লেখক: ইবনুল কায়্যিম রহ.
১০. আলামুল জিন (এই নামে ৩জন লেখকের আলাদা আলাদা বই আছে)
সবশেষে বলে রাখা ভালো, জ্বিন সিরিজ লিখতে গিয়ে আমি মৌলিকভাবে দুটি বইয়ের সহায়তা নিয়েছি, প্রথমত: ইমাম সুয়ুতির لقط المرجان في احكام الجان এটা মদীনা পাবলিকেশন্স থেকে জ্বিন জাতির ইতিহাস নামে অনূদিত হয়েছে। আর অপরটি হচ্ছে মিসরের শাইখ ওয়াহিদ এর লিখা وقاية الانسان من الجن والشيطان এটার অনুবাদ হয়নি। চিকিৎসার পদ্ধতিগুলো সাধারণত শেষোক্ত বই থেকে নেয়া। আর হাদিসের ক্ষেত্রে ইসলাম ওয়েব / জাওয়ামিউল কালিম থেকে আরবী কিতাবের সহায়তা নেয়া হয়েছে।
আগামী পর্বে ইনশাআল্লাহ জ্বিন সিরিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ। যেহেতু এব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই, এজন্য শুধু বই থেকে অনুবাদ করে লেখাটা ফুটিয়ে তোলা আমার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য একটা কাজ। এজন্য আপনাদের দু’আ প্রার্থী।
মন্তব্য করুন