[ক]
এবিষয়ে প্রথম আলোচনাটি প্রায় দেড় বছর আগে প্রকাশ হয়েছিল। গ্রুপের কয়েকজন এডমিন মিলে আমরা সেটি সংকলন করেছিলাম, পরে রুকইয়াহ বইয়েও এর সারকথা মুদ্রিত হয়েছে। সেই লেখাটিতে আমরা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকে বিভিন্ন যুগে সালাফদের পানিতে রুকইয়াহ করে ব্যবহার করার হাদিস, আসার, ঘটনা ও ফাতওয়া উল্লেখ করেছি। (প্রবন্ধের লিংক দেয়া হবে)
প্রথম পর্বের লিংক: https://ruqyahbd.org/blog/664/ruqyah-water
আজ আমরা এবিষয়ে খুব সংক্ষেপে কিছু ফিকহি আলোচনার পাশাপাশি একটি ভুল ধারণা নিরসনের চেষ্টা করব। ওয়াল্লাহু ওয়ালিয়্যুত তাওফিক।
পানিতে দোয়া-কালাম পড়ার বিষয়ে মোটাদাগে আলেমদের ২টি মত পাওয়া যায় –
১. সাধারণভাবে বৈধ।
২. বৈধ, তবে পান করার জন্য পড়লে সেক্ষেত্রে পানিতে ফুঁ দেবে না। অন্য কোনোভাবে পড়বে।
আরেকটি মত আছে, সেটা আলেমদের ফাতওয়া না, আম লোকদের ভুল বোঝার ফলে করা মন্তব্য, তা হচ্ছে পানিতে কিছু পড়াই যাবে না। এটা মূলত জাহালাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
[খ]
সুন্নাতে রাসূল থেকে প্রাপ্ত রুকইয়ার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, কোন ঔষধি গুণসম্পন্ন অথবা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ফজিলতপূর্ণ বন্তুতে রুকইয়াহ করে ব্যবহার করা। এজন্য বেশ কিছু পদ্ধতি অনুসৃত হয়, যেমন:
১. বস্তুটির কাছে মুখ নিয়ে তিলাওয়াত করা
২. তিলাওয়াতের পর ফুঁ দেয়া
৩. তিলাওয়াতের পর হালকা থুতুসহ ফুঁ দেয়া
৪. বস্তুটিতে হাত অথবা আঙ্গুল রেখে তিলাওয়াত করা, এরপর ব্যবহার করা
এর স্বপক্ষে যে হাদিসগুলো উল্লেখ্য –
১. আওফ ইবনে মালিক রা. থেকে বর্নিত, তিনি বলেন – আমরা জালেহিয়্যাতের সময়ে ঝাড়ফুঁক করতাম। তাই এব্যাপারে আমরা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি এ বিষয়টা কিভাবে দেখেন? তখন তিনি বললেন, “তোমাদের ঝাড়ফুঁকগুলো আমাকে দেখাও, রুকইয়াতে যদি শিরক না থাকে, তাহলে কোন সমস্যা নেই।“ (সহিহ মুসলিম, ৪০৭৯)
২. আলী রা. বর্ণনা করেন, একটি বিচ্ছু রাসূলুল্লাহ ﷺ কে নামাজরত অবস্থায় দংশন করল। নামাজ শেষ করে তিনি বললেন, “বিচ্ছুর উপর অভিশাপ, এটা নামাজি কিংবা বেনামাজি কাউকে ছাড় দেয় না।” তারপর তিনি পানি আর লবণ আনতে বললেন এবং সূরা কাফিরূন, ফালাক, নাস পড়তে লাগলেন আর আহত স্থানে লবণ-পানি দ্বারা ঘষতে লাগলেন।” (মুজামুল আওসাত ৫৮৮৬। সনদ হাসান)
হাদিসটি কয়েক সনদে পাওয়া যায়, এর কোনটায় শুধু সূরা ফালাক এবং নাসের কথা আছে, আর কোনটায় আছে পানিতে লবণ গুলিয়ে ওই জায়গায় ঢালছিলেন এবং চার কুল পড়ছিলেন।
৩. আয়িশা রা. বর্ণনা করেছেন, মানুষ কোন ব্যাথা, ফোঁড়া কিংবা জখমের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে বললে, তিনি তাঁর তার শাহাদাত আঙ্গুলটি “এরকম করে” এই দু’আ পড়তেনঃ
بِاسْمِ اللَّهِ تُرْبَةُ أَرْضِنَا بِرِيقَةِ بَعْضِنَا لِيُشْفَى بِهِ سَقِيمُنَا بِإِذْنِ رَبِّنَا
অর্থাৎ “আল্লাহর নামে, আমাদের যমীনের মাটি আমাদের কারো লালার সাথে (মিলিয়ে মালিশ করছি) আমাদের প্রতিপালকের হুকুমে, তা দিয়ে আমাদের রোগীর আরোগ্য প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে।”
বিষয়টি বুঝাবার জন্য হাদিসের বর্ণনাকারী সুফিয়ান ইবনে উওয়াইনাহ রহ. তার শাহাদাত আঙ্গুলটি মাটিতে লাগাতেন এরপর তা তুলে নিয়ে দু’আ পড়তেন। (মুসলিম ৪০৬৯)
৪. সাবিত ইবনু কাইস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি একবার অসুস্থ ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে আসেন। এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ এই দু’আটি পড়লেন: اَكْشِفِ الْبَأْسَ رَبَّ النَّاسِ (হে মানুষের প্রভু রোগমুক্ত করুন)
এরপর একটি পাত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ বাতহান উপত্যকার এক মুঠো মাটি রাখলেন, এরপর সেখানে পানি ঢাললেন এবং এতে ফুঁ দিলেন। তারপর ওই পানি তার (সাবিত ؓ এর) ওপর ঢেলে দেওয়া হল। (সুনান আবি দাউদ ৩৮৮৫)
অন্য হাদিসে রাসুল ﷺ বাতহান উপত্যকার ফজিলতের ব্যাপারে এরকম বলেছেন – বাতহান জান্নাতের একটি প্রণালীর অংশ (সিলসিলাতুস সহিহাহ)
[গ]
যে হাদিসের অনুবাদ থেকে ভুল ধারণা তৈরি হয় –
‘عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ أَبِي قَتَادَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا شَرِبَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَتَنَفَّسْ فِي الإِنَاءِ وَإِذَا بَالَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَمْسَحْ ذَكَرَه“ بِيَمِينِه„ وَإِذَا تَمَسَّحَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَتَمَسَّحْ بِيَمِينِهِ.
৫. আবূ ক্বাতাদা রা. থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “তোমাদের কোন ব্যক্তি যখন পানি পান করবে সে যেন তখন পানির পাত্রে নিঃশ্বাস না ফেলে।“ আর তোমাদের কেউ যখন প্রস্রাব করে, সে যেন ডান হাতে তার লজ্জাস্থান স্পর্শ না করে এবং তোমাদের কেউ যখন শৌচকার্য করে তখন সে যেন ডান হাতে না করে। (বুখারি ৫১১৫)
عَنْ أَبِي الْمُثَنَّى الْجُهَنِيِّ أَنَّهُ قَالَ
كُنْتُ عِنْدَ مَرْوَانَ بْنِ الْحَكَمِ فَدَخَلَ عَلَيْهِ أَبُو سَعِيدٍ الْخُدْرِيُّ فَقَالَ لَهُ مَرْوَانُ بْنُ الْحَكَمِ أَسَمِعْتَ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ نَهَى عَنْ النَّفْخِ فِي الشَّرَابِ فَقَالَ لَهُ أَبُو سَعِيدٍ نَعَمْ فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّي لَا أَرْوَى مِنْ نَفَسٍ وَاحِدٍ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَبِنْ الْقَدَحَ عَنْ فَاكَ ثُمَّ تَنَفَّسْ
আবূ মুসান্না জুহনী (র) থেকে বর্ণিত: আমি মারওয়ান ইবনে হাকামের কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় তার নিকট আবূ সাঈদ খুদরী রা. আগমন করলেন, তখন মারওয়ান তাঁকে বললেন, আপনি কি রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে শুনেছেন যে, তিনি পানীয় বস্তুতে শ্বাস ফেলতে নিষেধ করেছেন?
আবূ সাঈদ রা. উত্তর দিলেন, জি হ্যাঁ। এক ব্যক্তি বলেছিল, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি এক নিশ্বাসে (পানি পান করে) তৃপ্ত হই না। তখন রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পাত্রটিকে মুখ হতে পৃথক করে নিশ্বাস গ্রহণ কর। (তিরমিযী ১৮৮৭, মুয়াত্তা মালিক ১৬৬০)
পুরো হাদিস খেয়াল করলে না বোঝার কিছুই থাকে না। তবুও বলি। প্রথম হাদিসে فَلاَ يَتَنَفَّسْ এসেছে, দ্বিতীয়টিতে نَهَى عَنْ النَّفْخِ এসেছে। এই নাফাসা, নাফাখা শব্দের অবস্থাভেদে কিছু অর্থ হয় – ফুঁ দেয়া, শ্বাস ফেলা, ফোলানো, বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। কেউ কেউ ফুঁ দেয়া অর্থ ধরে পানিতে রুকইয়াহ করার ব্যাপারে ভুল ধারণা করে। হাদিসটি ভালোভাবে খেয়াল করলেই বুঝা যাচ্ছে, পানি খেতে খেতে আমরা অনেকে গ্লাসের মধ্যেই নিশ্বাস ছেড়ে দিই, এব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে। ফুঁ দেয়ার ব্যাপারে নয়। পরের হাদিস দেখলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়, সেখানে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পানি খাওয়ার সময় পাত্র সরিয়ে শ্বাস ফেলতে।
এছাড়া রুকইয়াহ বিষয়ে ফক্বিহদের সর্বসম্মত মূলনীতি (শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করা, কুফর-শিরক না থাকা, অস্পষ্ট – অবোধগম্য কিছু না হওয়া) এসবের সাথেও এর বিরোধ নেই।
আমাদের এক উস্তায হাদিস পড়ানোর সময় বলছিলেন, ফুঁ দেয়া আর ছু! দেয়া ভিন্ন বিষয়। ঝাড়ফুঁক হচ্ছে – ছু দেয়া।
[ঘ]
তবে… ইহতিয়াতান (সতর্কতা হিসেবে) কেউ যদি এথেকে বিরত থাকতে চায়, তবে আমরা এটাকে মন্দ বলব না। কারণ মুয়াত্তার বর্ণনায় শেষে এতটুকু অতিরিক্ত আছে- قَالَ فَإِنِّي أَرَى الْقَذَاةَ فِيه قَالَ فَأَهْرِقْهَا
সেই ব্যক্তি পুনরায় জিজ্ঞেস করল, পানিতে কোন ময়লা দেখলে তখন কি করব? (সম্ভবতঃ সে বুঝাতে চেয়েছিল, ফুঁ দিয়ে ময়লাটা সরিয়ে দেয়া যাবে কি না?) রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পানি ঢেলে ময়লাটা ফেলে দাও।
তো যারা সতর্কতা হিসেবে খাবারের পানিতে ফুঁ দেয়া থেকে বিরত থাকতে চায়, তারা কি করবে?
তারা গোসলের পানি বা অন্যান্য তেল, কালোজিরা ইত্যাদি পড়ার ক্ষেত্রে আগের মতই ফুঁ দিবে, যেহেতু এসবের ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, বরং প্রথমে উল্লেখিত কয়েটি হাদিস স্পষ্টতই এর পক্ষে বলেছে।
খাবার পানির ক্ষেত্রে – আয়াত বা দোয়া পড়ার পর হালকা থুতু দিবে। অর্থাৎ ফুঁ দেয়ার মতই, কিন্তু সাথে সামান্য শুকনা থুতু বের হবে। অথবা হাত ভালোভাবে ধৌত করে, পানিতে একটি আঙ্গুল রেখে পড়বে। এই দুই ব্যাপারেও কোন নিষেধাজ্ঞা নাই, বরং সাপ্লিমেন্টে আঙ্গুল রাখার হাদিস তো পেছনেই দেখেছেন।
আর হালকা থু দেয়ার বিষয়টা হল – কিছু হাদিসে এসেছে নবিজি জ্বিনের রোগীর রুকইয়ার পর রোগীর মুখে থুতু বা লালা দিয়েছেন। আলেমদের ইজতিহাদ হচ্ছে, যেহেতু বড়দের ক্ষেত্রে আমরা এভাবে সরাসরি থুতু দিতে পারি না, তাই পানিতে দিয়ে খেতে দেয়া যায়। কোন সমস্যা নেই।
যাহোক, আশা করছি বিষয়টা সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
মন্তব্য করুন