বেশ কিছু কারণে এমন হতে পারে, দীর্ঘদিন রুকইয়াহ করার পরেও রোগীর শরীর থেকে জ্বিন যাচ্ছে না। এখানে মোট ১১টি মৌলিক কারণ উল্লেখ করা হলো, এর বাইরেও আরো অনেক বিষয় থাকতে পারে।
এর মূল স্ক্রিপ্ট ইয়েমেনের শায়খ ইলিয়াস ফয়সালের, সেটা অনুযায়ী একটা গ্রুপে আলোচনা করেছিলাম, পরে রা.বি.র ফাহাদ ভাই নোট করে দিয়েছে। সামান্য কম-বেশ করে পোস্ট করা হল।
জিনের রোগীর রুকইয়ার বিস্তারিত নিয়ম আছে রুকইয়াহ সাপোর্ট বিডির ব্লগে, ফেসবুক পেজে এবং ‘রুকইয়াহ’ বইতে (লিংক নিচে থাকবে)। আজ আমরা শুধু শরীর থেকে জিন বের হওয়ার ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি।
——
১. জাদু : শরীরে ভিতরে/বাইরে জাদু থাকার কারনে বের হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে জিনকে জাদু করে তার স্মৃতি শক্তি নষ্ট করে দেয়, ফলে জ্বিন সব কিছু ভুলে যায়, বের হতে পারে না। কখনো কখনো জিন আটকে থাকে, বের হওয়ার রাস্তায় জাদু করা থাকে, চাইলেও বের হতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে হাত-পায়ে বা শরীরের যেখানে জাদু করা থাকে, সেখান থেকে জাদু নষ্ট করলে ইনশাআল্লাহ বের হতে পারবে।
কখনো কখনো জাদুকর জিনকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এজন্য ভয়ে বের হয় না। এরকম ক্ষেত্রে অভয় দিতে হবে এবং প্রয়োজনে সময় নিয়ে সেলফ রুকইয়ার করতে হবে।
২. অনেক পুরাতন জিন : এরা সহজে যেতে চায় না। শরীরে একপ্রকার ঘাটি গেড়ে থাকে বলা যায়। এদের অবস্থানের কারনে শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় প্রচণ্ড ব্যথা বা কোনো অঙ্গ একদম অচল হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে রুকইয়াহ চলাকালীন সময়ে ওই জায়গায় (মুরব্বিদের হাত-পা-মাথা টিপে দেয়ার মত) কিছুটা জোরে জোরে চাপ দেয়া, রুকইয়ার তেল দিয়ে ঘষামাজা করা, দোয়া পড়ে বারবার ফুঁক দেয়ার মাধ্যমে দুষ্টু জিনের থাকার জায়গা ভেঙ্গে দিলে এরপর বের হবে ইনশাআল্লাহ। (আল্লাহ চায়তো এভাবে রুকইয়ার করলে ওই অঙ্গে জাদু থাকলে সেটাও নষ্ট হয়ে যায়)। এছাড়াও ফোনে বা স্পিকারে রুকইয়ার অডিও প্লে করে ওই স্থানে চেপে ধরলেও উপকার হবে ইনশাআল্লাহ। (রোগী গাইরে মাহরাম হলে এসব ক্ষেত্রে উপস্থিত অভিভাবকের সাহায্য নিবেন।)
৩. আশিক/খবিস জিন : অল্প কিছুদিনের সমস্যা হলে সহজে বের করা যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত শরীরে থাকলে রোগীর সব দুর্বলতা জ্বিন বুঝতে পারে, ফলে সহজে বের হয় না৷ এই জ্বিন গুলা অনেক সময় নিজেরাই জাদুকর হয়। তাই এক্ষেত্রে জ্বিনের চিকিৎসার পাশাপাশি বশ করার জাদুর চিকিৎসা করলে উপকার হয়।
অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রাখে, রোগী নিজেই চায় না যে খবিসটা দূর হোক, বরং শয়তানের প্রতি টান অনুভব করে(নাউযুবিল্লাহ)। এরকম ক্ষেত্রে রোগীকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য কাউন্সিলিং করতে হবে, দ্বীন-দুনিয়ার লাভ ক্ষতি বুঝাতে হবে৷ এরপর আবার রুকইয়াহ করতে হবে।
৪. জিন অনেক দুর্বলঃ জ্বিনের দুর্বলতাও একটা কারণ হতে পারে, হয়তো বয়স একদম কম অথবা একদম বৃদ্ধ হয়ে গেসে এজন্য বের হতে পারছে না। কিংবা শারীরিক ভাবে এতই দুর্বল হয়ে গেছে যে নড়াচড়া করতে পারছে না। এরকম ক্ষেত্রে কানে আজান দিতে হবে বার বার। এছাড়া শরীর থেকে বের হওয়ার ওয়াদা নেয়ার পরে কানে কাছে সুরা ইয়াসিন পুরোটা তিলাওয়াত করলে অনেক দুর্বল জিনও সহজে বের হতে পারে।
আবার অনেক সময় জ্বীন ঠিকই বের হতে পারে, কিন্তু মিথ্যা বলে, ইচ্ছা করেই বের হয়না। এটাও খেয়াল রাখবেন যে, ধোকা দেয়ার চেষ্টা করছে কি না।
৫. ভুল চিকিৎসাঃ অনেক সময় ভুল চিকিৎসার কারনে জ্বিন শরীর থেকে যায় না। রুকইয়ার ক্ষেত্রে নিয়ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। জ্বিনের রোগিকে শুধুমাত্র বদনজরের রুকইয়াহ করা, অথবা জাদুর রোগিকে জাদুর রুকইয়াহ বাদ দিয়ে শুধু জ্বিনের রুকইয়াহ করা হলে জ্বিন এই সময় ও সুযোগটা কাজে লাগিয়ে জাদু শক্তিশালী করে। এজন্য ভালোভাবে ডায়াগনসিস করে তারপর চিকিৎসা শুরু করা উত্তম। না বুঝলে শুরুতে আমভাবে নিয়ত (যেমন: আমার সব সমস্যার জন্য রুকইয়ার করছি) করে রুকইয়ার শুরু করা যায়। আরেকটা বিষয় হল, জাদুর খাদেম জ্বিন সর্বদা শরীরে বা আশেপাশে থাকলে এক্ষেত্রে জাদু নষ্ট করে, কিছুদিন জাদুর রুকইয়াহ করে এরপর জ্বিন বের করার রুকইয়াহ করলে অধিক উপকার হয়।
৬. চিকিৎসার সময় করা কিছু ভুল : অনেক সময় রাক্বী বা রোগির আত্মীয়রা শয়তানের ফাদে পড়ে তিলাওয়াত বাদ দিয়ে গল্প গুজব করতে থাকে। কোনো সময় জ্বিন দুর্বলতা বুঝতে পেরে যেতে চায়, ফলে রাক্বী তিলাওয়াত বন্ধ করে দেয়। এরপর আর যায় না, অহেতুক সময় নষ্ট করে। অনেকে জিনদের মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করে রুকইয়াহ করা বন্ধ করে দেয়। শরীরে জিন লুকিয়ে থাকে, কিন্তু রাক্বী আর যাচাই করে দেখে না।
আরেকটা কারন হলো রুকইয়াহ করার পর আবার কবিরাজের কাছে যায়, ফলে নতুন জ্বিন শরীরে ঢুকে। অথবা আগে কোনো জ্বিনের সমস্যা ছিলো না কিন্তু কবিরাজের কাছে যাবার ফলে নতুন করে শরীরে জিন ঢুকতে পারে।
৭. ঈমান-আমলের দুর্বলতা : ঈমানের দুর্বলতার কারনে জ্বিন শরীর থেকে যায় না। রোগির ফরজ ইবাদাতে গাফিলতি, মাসনুন আমল না করা, তাকওয়ার ঘাটতি, ইয়াকিনে ঘাটতির কারনে রুকইয়াহ থেকে উল্লেখযোগ্য ফায়দা পায় না, আর জিনও শরীর থেকে যায় না।
৮. গুনাহ : গোপন ও প্রকাশ্য গুনাহ। অশ্লীলতার গুনাহ। গুনাহর কারনে আল্লাহর নিয়ামত দুরে সরে যায়। গুনাহর কারণে মানুষ রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়। উপরন্তু! অনেক রোগিকে জ্বিন-ই পাপ করতে উৎসাহ দেয়, কারণ রোগী পাপ করলে আত্মিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে, শয়তানকে পরাস্ত করতে পারে না৷ ফলে জিনও শরীর থেকে যায় না।
৯. মানুষের উপর জুলুম করা : রোগিকে কেউ বদ দোয়া করেছে যার ফলে সমস্যা ভালো হচ্ছে না। রোগি হয়ত কারো ওপর জুলুম করেছে বা কারও হক্ব নষ্ট করেছে। এরকম ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিতে হবে৷ আল্লাহর কাছেও ভালোভাবে তাওবা-ইস্তেগফার করতে হবে।
১০. রোগি অন্তর থেকে সুস্থ হতে না চাওয়া : কিছু রোগির নিয়তের ঘাটতি থাকে, অনেকে জ্বিন থাকাকেই ভালো মনে করে। কখনো জ্বিন দ্বারা উপকৃত হয়। ফলে রোগি জ্বিনের প্রতি মানসিক ভাবে দুর্বল থাকে। নিজেই পুরোপুরি চায় না শয়তান থেকে মুক্ত হতে, ফলে জ্বিন-শয়তানও শরীর থেকে বের হয় না। (ওপরের তিন নং পয়েন্টেও এব্যাপারে বলা হয়েছে)
—– ——
বিশেষ কারণঃ এই ১০টি কারণের বাইরে আরও একটি বিশেষ কারণ থাকতে পারে, আর তা হলো- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার পরীক্ষা, আল্লাহ তায়ালা হয়ত তাকে এই বিপদের উসিলায় বড় বড় পাপ মাফ করে দিবেন। আখিরাতের হিসাব সহজ করে দিবে। অথবা দুনিয়ার অন্যান্য বিপদ দুর করে দিবেন। অথবা এর কারনে জান্নাত দান করবেন।
যেমন, রাসুল ﷺ এর কাছে এক মহিলা সাহাবি এসেছিলেন তার সুস্থতার জন্য দোয়া চাইতে, তখন নবিজি স. ওই সাহাবিকে বলেছিলেনঃ তুমি যদি সবর করো তাহলে তুমি জান্নাত পাবে। ওই সাহাবী রা. বলেছিলেন, আমি সবর করবো। (বুখারী)
আরেকটি হাদিসে পাওয়া যায়, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, একজন মুসলিম ব্যক্তির উপর যত কষ্ট, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ ও পেরেশানী আসে, এমনকি যদি একটা কাঁটাও তার দেহে ফুটে, এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তার গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। (বুখারি, মুসলিম)
—
মোটের ওপরে এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে আমাদের জন্য শয়তানকে তাড়ানো সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
..
আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা দান করুক। আমিন।
আরও দেখুন
মন্তব্য করুন