গ্রুপের কাজ করতে যেয়ে যেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল, যদি কারও সমস্যার কথা শুনে যদি দুআ করতে বলি তাহলে মনেকরে তার সমস্যাকে গুরুত্ব দেই নি অথবা রাগ করে রুকইয়াহ সাজেস্ট না করে দুআ’র কথা বলেছি। অথচ দুআ’র গুরত্ব অপরিসীম। যাদুক্রান্ত হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে বার বার দুআ’ করেছিলেন, যার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবকে সুস্থ করেছিলেন। মেশকাত শরীফে হাদিস এসেছে যেখানে “দুআ’কে আসল ইবাদত”, “ইবাদতের মগজ” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (মেশকাত, ৫ম খণ্ড, এমদাদিয়া লাইব্রেরী। এর মানে কিন্তু এই না যে, ফরয ইবাদত বাদ দিয়ে শুধু দুআ’ই করে যাব!)
পরবর্তি কথা বলার আগের তাকদ্বীর বা ভাগ্য নিয়ে দুটো হাদিস শেয়ার করতে চাই।
১। সহীহ মুসলিমে আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “বদনজর সত্য, ভাগ্যের চেয়েও আগে বেড়ে যায় এমন কিছু যদি থাকতো, তাহলে অবশ্যই সেটা হতো বদনজর! যদি তোমাদের বদনজরের জন্য গোসল করতে বলা হয় তবে গোসল কর”। (ইফা, হাদিস নং ৫৫৩৯)
২। হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেনঃ তকদীরকে ফিরাতে পারে না দো’আ ছাড়া অপর কিছু এবং বয়স বাড়াইতে পারে না নেকি ছাড়া অপর কিছু। -তিরমিযি
ব্যাখ্যাঃ “ফিরাইতে পারে না” – অর্থাৎ লিখিত বিপদকে সহজ করিতে পারে না অথবা তকদীরকে ফিরাইবার মত যদি কিছু থাকিত উহা দো’আই হইত অথবা কোন কোন বিপদ সম্পর্কে তকদীরে এইরূপ রহিয়াছে যে, দো’আ দ্বারা ইয়া ফিরিয়া যাইবে। অর্থাৎ বিপদ ফিরাইবার জন্য দো’আ ছাড়া তথায় অন্য কোন জিনিসের উল্লেখ নাই। (মিশকাত, ৫ম খন্ড, পৃঃ৫৭, এমদাদিয়া লাইব্রেরি)
এই দুই হাদিসের সরল অর্থ যদি নেই তাহলে বলতে হবে বদনজর যেভাবে ভাগ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে তেমনি দুআ’ বিপর্যস্থ ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করতে পারে। প্যারানরমাল সমস্যাগুলোর মধ্যে বদনজর সবচে ধ্বংসাত্মক এবং দ্রুত কার্যকরী। নজর লাগার সাথে সাথে ইফেক্ট শুরু হয়। যেখানে জ্বিন ও যাদু হল অনেকটা স্লো পয়জনের মত। ধীরে ধীরে আপনাকে কাবু করে ফেলবে। একইভাবে দুআ’ অনেক শক্তিশালি একটি আমল যা থেকে আমরা অজ্ঞতাবশত হোক বা শয়তানের ধোকায় পড়ে হোক বা অবহেলা করেই হোক, বিরত থাকি। একাগ্র চিত্তে দুআ’ করেছেন এমন মানুষ হয়ত এক হাতে গুনেই দিতে পারব। অথচ আমাদের পুর্বসূরিরা এমন ছিলেন না। তারা যেকোন প্রয়োজনে সালাতের মাধ্যমে, দুআ’র মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য ও মদদ চাইতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোন সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু কোন হাজত/সমস্যার কথা প্রকাশ করলে তিনি দুআ’ শিক্ষা দিতেন এমন অনেক হাদিস আমরা পাই।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
১। যারা প্রার্থণা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থণা করে। (সুরা বাকারা-১৮৬)
২। বল তো কে নিঃসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন (সুরা নামল -৬২)
কাজেই আমাদের দুআ’ করাটাই বাকি শুধু, আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন দুআ’ করলেই।
তবে দুআ’র ক্ষেত্রে কিছু শর্ত ও আদবের দিকে লক্ষ রাখা জরুরীঃ
১। দুআ’র ফলাফল চোখে দেখি বা না দেখি দুআ’ করে যেতে হবে।
২। দুআ’র করে এই কথা না বলা যে, “দুআ’ করি কিন্তু দুআ’ কবুল হয় না”। এসব বলা বেয়াদবি এবং দুআ’ কবুল না হবার কারন।
৩। রুজী হালাল হওয়া।
৪। হারাম বিষয়ে দুআ’ না করা। যেমনঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে চেয়ে দুআ’ করা।
৫। সমাজে ব্যাপকভাবে অশ্লীলতা, ফায়েসা কাজের প্রসার এবং এগুলো বন্ধের জন্য কোন চেষ্টা না করা।
৬। নির্দিষ্ট না করা বরং ব্যাপকভাবে করা। যেমন কোন কাজের জন্য ১০ হাজার টাকা দরকার। এখন “আল্লাহ ১০ হাজার টাকা দাও” এভাবে না বলে “আল্লাহ আমার অমুক কাজটা সমাধা করে দাও”-এভাবে বলা।
৭। দৃঢ়ভাবে দুআ’ করা। যেন অনেকটা আল্লাহর খাজানা থেকে কেড়ে নেয়া। হে আল্লাহ, আমাকেই দিয়েই দাও। আমাকেই দাও- কবুল হবে এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখা। “হে আল্লাহ, তোমার ইচ্ছা হলে দাও।”-এভাবে না চাওয়া। নাছোরবান্দা ভিখিরির মত চাইতেই থাকা।
৮। দুআ’ মনোযোগ দিয়ে করা। দুআ’ করছি আর ভাবছি কিভাবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিব এমন দুআ’য় কতটুকু ফায়দা?
৯। দুআ’য় কান্নাকাটি করা বা কান্না করার ভাব করা।
[সোর্সঃ মাসিক আলকাউসারের একটি প্রবন্ধ থেকে মূলভাব নেয়া হয়েছে]
১০। ফরজ, ওয়াজিব আমল বাদ দিয়ে দুআ’য় মশুগুল না হওয়া।
১১। দোয়ার পর “মোহর” লাগানো তথা আমীন বলা। (মুন্তাখাব হাদীস, পৃ-৪৫১)
১২। বিনীত ও চুপিচুপি দুআ’ করা (সুরা আরাফ-৫৬)
১৩। আল্লাহ তায়ালার নাম সমূহের দ্বারা ডেকে ডেকে দুআ’ করা। (সুরা আরাফ-১৮)
১৪। নিচের বাক্যগুলো দুআ’তে বলা
i)সুরা বাকারার ১৬৩ নং আয়াত
ii)সুরা আলে ইমরানের প্রথম আয়াত
iii)লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার
iv) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহ
v)লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুওয়া আ’লা কুল্লি শাইয়িন ক্বদির
vi)লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
vii) ওলা হাওলা ওলা ক্বুওওতা ইল্লা বিল্লাহ
viii)ইয়া যালজালালি ওয়াল ইকরাম (এই বাক্য বলে কাকুতি মিনতি করা)
ix) দোয়ায়ে ইউনুস। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নি কুন্তু মিনাযলিমিন
১৫) অন্যের নিকট দুআ’র অনুরোধ করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। (মেশকাত, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬০, এমদাদিয়া লাইব্রেরী)
(সোর্সঃমুন্তাখাব হাদিস। এই দোয়াগুলোর আরবী দেখে পড়বেন। নাহলে উচ্চারন শুদ্ধ হবার সম্ভবনা কম)
দুআ’ কবুলের স্থান, কাল, পাত্র
১। সুখের সময় বেশি বেশি দুআ’ করা তাহলে কষ্টের সময় সহজেই দুআ’ কবুল হয়। (মেশকাত, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৮, এমদাদিয়া লাইব্রেরী)
২। রোযাদারের দুআ’ কবুল হয় যখন সে ইফতার করে।
৩। ন্যায় বিচারক শাসকের দুআ’।
৪। অত্যাচারিতের দুআ’, যতক্ষন না প্রতিশোধ গ্রহন করে।
৫। পিতার দুআ’।
৬। মুসাফিরের দুআ’।
৭। হাজী সাহেবের দুআ’ যতক্ষন না তিনি বাড়ি ফিরে আসেন।
৮। জিহাদকারীর দুআ’ যতক্ষন না জিহাদ থেকে বিরত হয়।
৯। এক মুসলমান ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য অন্য মুসলমান ভাইয়ের দুআ’।
(মেশকাত, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬০,৬১,৬৩, এমদাদিয়া লাইব্রেরী)
১০। আযান ও ইকামতের মাঝে দুআ’ রদ করা হয় না (তিরমিযি, ইফা, ১ম খণ্ড, পৃ-২০৫)
দুআ’র বিনিময়
হযরত আবু সায়ীদ খদরী (রাঃ) বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেনঃ যে কোন মুসলমান যে কোন দো’আ করে যাহাত কোন গুনাহর কাজ অথবা আত্মীয়তা বন্ধন ছেদের কথা নাই, নিশ্চয়ই, আল্লাহ তাহাকে এই তিনটির একটি দান করেন। তাহাকে তাহার চাওয়া বস্তু দুনিয়াতে দান করেন অথবা উহা তাহার পরকালের জন্য জমা রাখেন অথবা উহার অনুরূপ কোন অমঙ্গলকে তাহা হইতে দূরে রাখেন। সাহাবীগণ বলিলেন, তবে তো আমরা অনেক লাভ করিব। হুযুর বলিলেন, আল্লাহ্ ইহা অপেক্ষাও অধিক দেন। -আহমাদ
(মেশকাত, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৩, এমদাদিয়া লাইব্রেরী)
আমি আপনি যদি দুআ’ করতে শিখে যাই তাহলে ইনশাআল্লাহ দুআ’ই আমাদের জন্য যথেষ্ঠ হবে। এরপর চিকিৎসা হিসেবে রুকইয়াহতো আছেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তৌফিক দিন বেশি বেশি দুআ’ করার, এমনভাবে দুআ’ করার যেন আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট হন। আল্লাহ তায়ালা প্রথমে আমাকে আমল করার তৌফিক দিন, এরপর অন্যদের দিন। আমীন।
মন্তব্য করুন