Ruqyah Support BD

এক বোনের ভয়ংকর জিনের সমস্যা এবং তার চিকিৎসার ঘটনা…

এই ঘটনাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ি সবাই। অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।
এক বোনের কাহিনি শুনি তার জবানীতে……

“বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।” আসলেই কথাটির মর্ম আমি বুঝতে পেরেছি আমার দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে। প্রতিটি মানুষের জীবনে কোন না কোণ ঘটনা থাকে। আমি যখন আমার মায়ের পেটে ছিলাম তখন থেকেই আমার প্রতি কোন না কোন সাপের ঘৃণা ছিল। আমি বহুবার স্বপ্নে এমন দেখেছি যে, আমি গর্ভে থাকা অবস্থায় মা নাকি ভুল করে একটি সাপ মেরে ফেলেন। কিন্তু মায়ের এমন কিছু মনে নেই। তারপর আমার অবস্থার অবনতি হতে থাকলে মা বুঝতে পারেন তিনি আসলেই হয়ত এমন কাজ করেছেন কারণ তার অভ্যাস ছিল সাপ মারা। তিনি জানতেন সাপ মারা সুন্নত। এখন তিনি বুঝতে পারেন তিনি সাপ ভেবে যা মেরেছিলেন তা আদতে সাপ ছিল না। এই সাপ মারার পর থেকে মা বিভিন্ন সময় অসুস্থ থাকতেন। আমি জন্মের পর থেকে নানা রোগে-শোকে ভুগতে থাকি। দুই-একদিন পরপরই আমাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হত। খাওয়া-দাওয়ায় আমার তেমন রুচি ছিল না। ছোট থেকে নানা কিছু স্বপ্নে দেখতাম। রাতে দেখে দিনের বেলায় ভুলে যেতাম। স্বপ্ন নিয়ে তেমন ভাবনাও ছিল না। ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নই আমাকে সুস্থ হতে সাহায্য করেছে।
যখন থেকে স্বপ্ন মনে থাকত তখন পরিবারের সাথে এগুলো বলতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার বেশ মন খারাপ থাকত। আর মেজাজও গরম থাকত। আমি কাউকে সহ্য করতে পারতাম না। এমনকি মাকেও সহ্য হত না। এভাবে চলতে থাকে কয়েক বছর। যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি তখন বাসায় নানা রকমের স্বপ্নের কথা বলতাম। তখন স্বপ্ন দেখলে মনে থাকত। আমি স্বপ্নে সাপ দেখতাম রোজ। তারা আমার ক্ষতি করত না। আরও দেখতাম সাপেরা আমাকে নিয়ে এমন কোথাও যাচ্ছে যেখানে আগে কখনই যাই নি। আমার খুব ভাল লাগত। তাই পরে আর এসব কথা কাউকে বলিনি। এভাবে সাপের প্রতি আমার মায়ের চেয়েও বেশি আকর্ষন তৈরি হয়। সবসময় সাপ, কবুতর, কুকুর, পেঁচা ইত্যাদি দেখতাম স্বপ্নে। এমনকি পরীক্ষার হলে লেখার সময়ও দেখতাম কলমের মাথায় সাপ বসে আছে। তখন আমি সবকিছু ভুলে যেতাম। পড়ে আসা পড়া কিছুতেই মনে করতে পারতাম না।
আমার ধৈর্য্যও কমে যেতে লাগল। রাগ এবং জিদ বাড়তে লাগল। পরিবারের মানুষজন থেকে দূরে সরে যেতে থাকলাম। একা একা থাকতে ভাল লাগত। কোণ পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, হৈচৈ ভাল লাগত না। কারও সাথে মিশতে পারতাম না, মন খুলে কথা বলতে পারতাম না। রাস্তায় চলাচল করতে পারতাম না, গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে যেত। বেশিরভাগ সময় কলেজ থেকে আসার সময় যে পুকুরগুলো পড়ত সবগুলোতে রাস্তা থেকে সাপ দেখতে পেতাম যা আর কেউ দেখত না। আমার জীবন এভাবেই কাটতে থাকে।
আরও কয়েকবছর পর আমাকে আমাদের বাড়ির সামনের এক ফকিরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমাকে দেখে বলেন আমার সাথে খারাপ জ্বিন আছে। সেখান থেকে আমাকে দুইটি তাবিজ দেয়া হয়। একটি গলায় এবং অন্যটি বা হাতে পড়ার জন্য। আমাকে পানি পড়া ও তেলপড়াও দেয়া হয়। এভাবে চলতে থাকে। একমাস পর্যন্ত আমার মধ্যে কোণ পরিবর্তন এল না। এরপর আমাদের এলাকার ইমাম সাহেবকে আমাদের বাসায় ডেকে নিয়ে আসা হল। তিনি আমার কথা শুনে ভাবলেন হয়ত আমি খারাপ স্বপ্ন দেখি তাই ভয় পেয়ে এমন আচরণ করি। কিন্তু সব কথা শোনার পর আমাকে পানি পড়া, মধু ও তাবিজ দেন। সাথে সাথে দুপুর বারোটার আগেই তার দেয়া পানি পড়া দিয়ে গোসল করতে বলেন। আর ভরদুপুরে কোনভাবেই বাইরে যেতে মানা করেন।
এসব নিয়ম-কানুন মেনে চলার পর কিছুদিন স্বপ্নে সাপ দেখেনি। তবে আমার শারীরিক দুর্বলতা তখনও কাটেনি। একদিন হঠাৎ করেই আমার শরীর থেকে তাবিজ পড়ে যায়। কোথায়, কখন পড়ে যায় কিছুতেই মনে করতে পারি নি। এভাবে সময় কাটতে থাকে। কিন্তু দিন দিন আমার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এরপর আমাকে মাদ্রাসার এক হুজুর দেখানো হল। তিনি আমার সব সমস্যার কথা শুনে আমাকে পানি পড়া ও সরিষার তেল পড়া দিলেন এবং দশটি কাচের প্লেটে কিছু লিখে দেন যেগুলো ধুয়ে পানি পান করতে বলেন। এসব মেনে চলার পরও আমার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। এবং আমি অজ্ঞান থাকি। এই নিয়ম-কানুন আমার বড়ভাই এবং আমার চাচা করিয়েছেন। পরে তাদের কাছে এসব শুনেছি। আমি অজ্ঞান থাকাতে উনারা ভয় পেয়ে যান।
আমার বড় ফুপার মাধ্যমে মিরপুরের এক কবিরাজের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি জানান তিনি দূর থেকেই নামের উপর চিকিৎসা করতে পারবেন। আমার সুস্থতার জন্য পরিবারের সবাই এতটাই ব্যাকুল ছিল যে, যে যাই বলত তাই মানার চেষ্টা করত। সেই পথ্য দেন একমাস ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। ঘরে গোসল থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করতে হবে। আর তার দেয়া মাটির হাড়ি ভেঙে পানি পান করতে হবে এবং গোসল করতে হবে। সবকিছু ঠিকমতই করা হলেও আমার কোণ উন্নতি হল না। কবিরাজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, তিনি জ্বিনদের আটকানোর, বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তারা তার কোন কথাই নাকি শোনেনি। বরং জ্বিনেরা তাকে মারধর করে অসুস্থ করে ফেলেছে। এরপর কবিরাজ মহাশয় সাফ বলে দিলেন আমার চিকিৎসা তিনি করতে পারবেন না। তিনি অন্য এক কবিরাজের খোজ দিলেন। ঐ কবিরাজ অগ্রিম টাকা ছাড়া কাজ করেন না। আর কাজ না হলে নাকি টাকা ফেরত। তার দাবি ছিল নদীর সাত ঘাটের পাল লাগবে এবং যে নদীতে সবার আগে জোয়ার আসে সেই নদীর পানি লাগবে। আর কিছু রক্তজবা ও আমপাতা একটি মাটির হাড়ীতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তিনি দূর থেকে জ্বিন দ্বারা সেই হাড়িতে ঝাড়ফুঁক করবেন। কিন্তু এসব করার পরও আমার কোন উন্নতি হল না।
এরপর কিছুদিন চিকিৎসা বন্ধ ছিল। হঠাৎ একদিন আমার খালু পুরান ঢাকার এক কবিরাজের সন্ধান পান। তার কাছে যাবার পর তিনি আমাকে দেখে হাসলেন এবং হাত দেখে বললেন আমি নাকি রূপ ধারণ করি। এই সময় আমার জ্ঞান ছিল না। আমি পরে বড়োদের কাছে এসব শুনেছি। সেখানে এক মহিলার উপর জ্বিন হাজির করা হয়। এরপর আমার হাত দক্ষে বলে আমাকে যাদুকরি ধরেছে। সে সবসময় আমাকে যাদু করে আমার চিকিৎসার যাবতীয় কার্যক্রম নস্যাৎ করে দেয়। তিনি আমাকে কয়েকটি মোমবাতি জ্বালিয়ে একটি আরবি লেখা কাগজ পুড়িয়ে সেই কাপড়ে ধোয়া চোখে লাগাতে বলেন আর সাতটি নদীর মোহনা থেকে পানি আনতে বলেন আমাকে গোসল করানোর জন্য। এভাবে চলে যায় আরও কিছুদিন। দিন যত যাচ্ছিল আমি আমার পরিবার থেকে ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম।
অবশেষে আমাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তারা আমাকে কাউনসিলিং করতে বলেন। এটা বেশ ব্যয়বহুল ছিল। তবুও খালমনি আমাকে কাউনসিলিং করান বেশ কিছুদিন। ডাক্তাররা আমাকে মানসিক রোগী ভেবে ঘুমের ওষুধ দিতেন। এই ওষুধ খেলে দিনের অর্ধেক সময় পর্যন্ত আমার ঘুমিয়ে কাটত। দুই মাস খাওয়ার পর ওষুধ খাওয়া বন্ধ করি।
এরপর মামার মাধ্যমে ফুলবাড়িয়ার এক কবিরাজের সন্ধান পাই। তার চিকিৎসা পদ্ধতি একটু ভিন্ন। তার কথা শুনে মনে হল আমাকে সুস্থ করা তার জন্য কোন বিষয়ই না। তিনি কত রাজা-উজির মেরেছেন তার গল্প আমাদের শোনাতে লাগলেন। তারপর কবিরাজ আমাকে ভরসা দিলেন যে আমাকে তিনি সুস্থ করে তুলবেন। তিনি বোঝালেন, তার ঘরেও মা-বোন আছেন। তাই আমার উপর জ্বিন হাজির করবেন না। কারণ জ্বিন হাজির হলে কোণ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। তাই তিন তার বাড়ির কয়েকজন ছেলে-মেয়েকে ডাকলেন এবং তাদের উপর জ্বিন হাজির করলেন। তিনি তাদের এমনভাবে প্রশ্ন করতে লাগলে যার উত্তর “হ্যা/না” দিয়ে দেয়া যায়। এহেন কাজকর্মে আমরা কিছুটা আশ্বস্থ হলাম। তবে আমাদের সাথে যে ভাইয়া গিয়েছিলেন তিনি বললেন আমার উপরে জ্বিন হাজির করাতে। এতে কবিরাজ আমাদের নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখাতে লাগলেন। যেমন, জ্বীন হাজির হয়ে যদি আমার কোন ক্ষতি করে তাহলে সে দায় তিনি নিবেন না-ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরাও ভয় পেয়ে তার কথায় সম্মত হলাম। তারপর আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে আমার কথা শুনে বললেন, আমি নাকি মিথ্যে বলছি। কিন্তু আমিতো জানি আমার সাথে কি কি হত। এরপর কবিরাজ আমাকে খুব ধমকাতে লাগলেন আর বার বার আমাকে মিথ্যুক বলছিলেন। এরপর তিনি আমার সাথে থাকা জ্বিনকে নাকি আটকে ফেললেন এবং একটা পরী এসে নাকি সেই জ্বিনকে খেয়ে ফেলেছে। কাজ শেষ হবার পর বললেন, আমাদের কাছ থেকে তিনি কোন পারিশ্রমিক নিবেন না। কিন্তু তার ভক্তদের জন্য টাকা দিতে হবে। আরও বললেন, আমার জানের সদকা দিতে হবে আর তার গুরুকে খুশি করে দিতে হবে।
আমাকে সুস্থ করার জন্য আমার মামা তার সব কথা মেনে নিলেন এবং নগদ দশ হাজার টাকা দিয়ে দিলেন। এছাড়াও তামাকে কয়েক পদের পাতা দেন এবং এগুলো পানিতে গরম করে গোসল করতে বলেন। সাথে সাথে চিনি পড়া দেন খাওয়ার জন্য, মেশিনে ভাঙানো প্রথম সরিষার তেল দেন। হাতে বাধার জন্য তাবিজও দেন। তালের আটি দেন। আরও কিছু নিয়ম মেনে চলতে বলেন। আমাদের ঢাকায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। রাতে ভালই ছিলাম। গোসল করি, খাবারও খাই। কিন্তু পরের দিন ঘটে মারাত্মক এক ঘটনা। আমি নাকি নিজেই আমার গলায় ওড়ান পেঁচিয়ে ফাঁসি নিতে চেয়েছি! আমাকে নাকি কেউ ফিরিয়ে রাখতে পারে না।! এক পর্যায়ে আমার নাক-মুখ লাল হয়ে যায়, দাতে কপাটি লেগে যায়। এভাবে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত চলতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হই। এসব কিছুই আমার মনে নেই।

এবারে আমাদের জবানীতে লিখি-
রুকইয়াহ গ্রুপের কার্যক্রম তখন কেবল শুরু হয়েছে। আমাদের দু’জন ভাই উনাকে রুকইয়াহ করলেন। প্রথমদিকে টানা ৬-৭ ঘন্টা রুকইয়াহ করা হয়েছে। জ্বিন ছাড়তে চায় না। রুকইয়াহ করার সময় নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। যেমন, শ্বাসকষ্ট, দাঁতে দাঁতে লেগে যাওয়া, ওড়না গলায় পেঁচিয়ে ফাঁস নিতে চেষ্টা করা, গোঙানি ইত্যাদি। দ্বিতীয়দিনে তাকে বলা হল, কালেমা পড়। তিনি কালেমা পড়ার চেষ্টা করতেই জ্বিন এসে তাকে অজ্ঞান করে দিল। সাথে সাথে একভাই রুকইয়াহ করা শুরু করলেন। ঘন্টা খানেক রুকইয়াহ করার পর তিনি কিছুটা ধাতস্থ হলেন। এভাবে সপ্তাহখানেক ধরে প্রতিদিন তাকে রুকইয়াহ করা হত। পরের দিকে তার সমস্যা অনেক কমে আসে। তিনি নিজে নিজেই রুকইয়াহর আয়াত গুলো পড়তে পারতেন। আবার গরুর গোশত খাওয়া শুরু করলেন, নামাযে নিয়মিত হলেন। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে লাগলেন।

ঘটনার প্রায় ৪ বছর পার হয়ে গেছে, উনি ভালই আছেন। এখনও তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, কখনও যেন সেই সমস্যা  ফিরে না আসে। আমরাও তার জন্য এমনটাই দোয়া করি।  আল্লাহ কবুল করে নিন। আমীন।

মন্তব্য করুন