[ক]
জিন জাতির অধিকার
…অনুরূপভাবে জিন জাতিও এ জগতের বাসিন্দা যাদের অধিকার রয়েছে। তাদেরকে অন্ন, বাসস্থান ও নিরাপত্তার অধিকার দেয়া হয়েছে, যা খর্ব করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। যেরূপ তারা বিরাণ অঞ্চলে থাকে, তেমনি আমাদের ঘর বাড়িতেও থাকার অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়েছে। হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, প্রতিটি বাড়িতে জিন বসবাস করে। যেহেতু তারা নিজ কাজে লিপ্ত থাকে আর আমরা আমাদের কাজে; তাই আমাদের খবর থাকেনা যে, কোনাে জিন আমাদের ঘরে বসবাস করছে। অবশ্য যে জিন মন্দ স্বভাবের, দুষ্ট, ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী হয় আর আমাদের কষ্ট দেয়, তখন আমরা বলে থাকি অমুক ঘরে জিনের প্রভাব আছে, আর আলেমদের দ্বারস্ত হয়ে বলি যে, আমলের মাধ্যমে ওই জিনকে বন্দী করুন বা জ্বালিয়ে ফেলুন।
মোটকথা, জিন যখন ক্ষতি করতে তৎপর হয় তখন তাদের সাথে মোকাবেলা; বরং লড়াই করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
নতুবা ঈমানদার, নেককার জিন হলে আমাদের ঘর থেকে তাদের বের করে দেয়ার চিন্তায় থাকার দরকার নেই; বরং তাদের আনুগত্য ইবাদত ও শক্তি দ্বারা আমাদেরও উপকার হবে। আর যদি বদকার হয় বা কষ্ট দেয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তার দুর্ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।
[খ]
জিন জাতির বিভিন্ন ধর্ম
সারকথা, জিন জাতির মধ্যে সর্বপ্রকারের জিন বিদ্যমান। ভালা আছে মন্দও আছে। মুসলিম আছে অমুসলিম আছে। মুশরিক, ইহুদি এবং খ্রিস্টান আছে। যেমন কুরআনে কারীম এদিকে খোলাখুলি ইঙ্গিত করেছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের পূর্বে তারা আসমানের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারতো এবং ফেরেশতাদের আলাপ-আলোচনা শুনে খোদায়ী ওহীর কিছু কথা শুনে ফেলতো। তাতে নিজের তরফ থেকে আরও মিথ্যে মিশিয়ে তাদের অনুসারীদের শােনাতাে। অতঃপর গায়েব জানার দাবি করে মানুষকে তাদের জালে ফাঁসিয়ে দিতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী হবার সময় তাদের আসমানে আরোহণ বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন তারা এই ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লাে যে, এ কেমন নতুন ঘটনা যা আমাদের উপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে? কী নতুন বিষয় প্রকাশ পেলাে যার কারণে আমাদের উপর অবরোধ আরোপ করা হলাে? অতঃপর কতিপয় জিন কারণ অনুসন্ধানে বের হয়ে পূর্ব-পশ্চিম ঘুরে বেড়ালাে। কেউ পশ্চিমে গেলাে। কেউ পূর্বে গেলাে। কেউ উত্তরে গেলাে। কেউ দক্ষিণে। তাদের একদল অতিক্রম করে মক্কার পথে। সেখানে দেখলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন তিলাওয়াত করছেন।
তারা কুরআনের বিধান সুস্পষ্ট ও দিকনির্দেশনামূলক দেখে এবং এটা বুঝতে পারে যে, এর পথনির্দেশ তাে ঠিক আমাদের মন্দের বিরুদ্ধে। তারা উপলব্ধি করতে পারলাে এটাই সেই কারণ, যা আমাদের এবং আমাদের মন্দ কাজের পথ অবরুদ্ধ করেছে। তারা সংবাদটি তাদের ভাইদের কাছে পৌঁছে দিলো –
إِنَّا سَمِعْنَا قُرْءَانًا عَجَبًا * يَهْدِىٓ إِلَى ٱلرُّشْدِ فَـَٔامَنَّا بِهِ
অর্থ : আমরা বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি, যা সৎপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। (সূরা জিন : ১-২)
এর দ্বারা বুঝা গেল যে, তাদের মধ্যে কাফির আছে, যারা পরে ঈমান এনেছে। অতএব, তাদের মধ্যে কাফির ও মুমিন উভয় দল সাব্যস্ত হলো।
তারপর তারা বলল –
وَلَن نُّشْرِكَ بِرَبِّنَآ أَحَدًا
অর্থ : আমরা আর কখনাে আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না। (সূরা জিন : ২)
এ থেকে বোঝা গেল যে, তাদের মধ্যে মুওয়াহহিদ ও মুশরিক উভয়দল ছিল। কিছু জ্বিন ছিল মুশরিক, কিছু মুওয়াহহিদ।
অতঃপর বলা হয়েছে –
وَأَنَّهُۥ تَعَٰلَىٰ جَدُّ رَبِّنَا مَا ٱتَّخَذَ صَٰحِبَةً وَلَا وَلَدًا
অর্থ : আমাদের মহান পালনকর্তার মর্যাদা সবার উর্ধ্বে, তিনি কোন পত্নী গ্রহণ করেননি এবং তাঁর কোন সন্তান নেই। (সূরা জিন : ৩)
এ থেকে বোঝা গেল যে, তাদের মধ্যে কিছু খ্রিষ্টান জ্বিন ছিলো যারা (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহর স্ত্রী ও সন্তান থাকার আকীদায় বিশ্বাসী ছিলাে।
অতঃপর বলা হয়েছে –
وَأَنَّهُۥ كَانَ يَقُولُ سَفِيهُنَا عَلَى ٱللَّهِ شَطَطًا
অর্থ : আমাদের মধ্যে নির্বোধেরা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে বাড়াবাড়ির কথা বলতাে। (সূরা জিন : ৪)।
এ থেকে বোঝা গেল যে, তাদের মধ্যে মুলহিদও ছিল, যারা নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও দুর্বুদ্ধির কারণে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে ধর্মকে অধর্ম বানানো এবং আল্লাহ প্রদত্ত ওহীর নাম দিয়ে নিজের নষ্ট ধারণাগুলােকে প্রচার করতে অভ্যস্ত ছিল।
অতএব, উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেলে যে, জিনিস মধ্যে বিভিন্ন দল-মত ও বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের জিন আছে। তথাপি এসব কারণে তাদের প্রাপ্য অধিকারের উপর কোন প্রভাব পড়ে না। বেশি থেকে বেশি বদকার জিনদের শাস্তি দেয়া যেতে পারে যেরকম বদ মানুষকে দেয়া হয়। কিন্তু তাদের অধিকারে বাধা দেয়া যাবে না।
এমনকি ফকীহগণ এ বিষয়েও আলোচনা করেছেন যে, মুসলমান জিন নারীর সাথে বিয়ে শাদী করতে পারবে কী না!!
কোন কোন ফকীহ এ বিয়েকে জায়েয বলেছেন। কেউ বলেছেন জায়েয হবে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলাে- নেকাহ স্বজাতির সাথে হতে পারে, ভিন্ন জাতির সাথে নয়। তারা এ বিয়েকে জায়েয দেন না। কারণ তখন বিয়েটা গরু-ছাগলের সাথে বিয়ের মতাে হবে। কারণ গরু-ছাগল ভিন্ন জাতি। তাই এ বিয়ে হবে না।। আর যাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলাে-জিনদের মধ্যে বিবেক আছে। তারা শরীয়তের সম্বোধিত এবং বিধান মানতে বাধ্য। এছাড়া মানবীয় রূপ ধারণ করতে পারে। এ দৃষ্টিতে তারা জায়েজ বলে ফতোয়া দেন। |
মোটকথা, জিনের বিভিন্ন অধিকার রয়েছে। কিছু খাদ্যের অধিকার, কিছু বাসস্থানের অধিকার, আর প্রতিবেশী হিসেবেও তাদের কিছু অধিকার রয়েছে। এসব অধিকার আদায় করা আবশ্যক।
[গ]
জিন জাতির মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তাবলীগ
হাদীস শরীফে এসেছে যে, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খিদমতে নাসীবাইন জিনের একটি প্রতিনিধি দল এলো। দলটি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ভাইদের একটি দল অমুক জায়গায় একত্রিত হয়েছে, আপনি এসে তাদের নসীহত করুন এবং তাদের সম্পর্কে আহকাম (বিধিনিষেধ) বলুন। আর তাদের কিছু জিজ্ঞাসা আছে তারা সেগুলোর সমাধান চাচ্ছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ নিয়ে গেলেন। সাথে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সেই পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছলেন, যেখানে জিনদের সমাবেশ হচ্ছিলাে। তখন তিনি একটি বৃত্ত টানলেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে বললেন, এই বৃত্তের বাইরে বের হবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমি দেখতে পেলাম বিভিন্ন অদ্ভুত আকৃতির ব্যক্তি ওই বৃত্তের বাইরে চলাফেরা করছে, কিন্তু বৃত্তের ভেতরে আসতে পারছে না। তাদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সমাবেশে পৌঁছেছেন এবং নসিহত করলেন আর মাসায়েল বাতলে দিলেন। সেখানেই বলেন,
فلا تستنجوا بهما، فإنهما طعام إخوانكم
‘তোমরা কেউ হাড্ডি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করবে না।’ আর এর কারণ বললেন, ‘এটা তােমাদের জিন ভাইদের আহার্য।’ (সহীহ মুসলিম: ৪৫০)
যা থেকে স্পষ্ট হলো যে, তাদের খাদ্যের অধিকার খর্ব করা জায়েয নয়। এ কথাও (পূর্বোক্ত) হাদীসেই আছে, যখন তােমরা হাড় থেকে গােশত খেয়ে নাও, তখন জিন জাতি এই হাড়কে গােশত সহকারে পেয়ে থাকে।
সুতরাং জানা গেল যে, ইসলামের সূচনা যুগে মানুষ হাড়/হাড্ডি দিয়ে শৌচকর্ম সম্পাদন করতো। এই কারণে জিনেরা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে অভিযোগ করে। তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে হাড় দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতে বারণ করে দিলেন। যা থেকে জিন জাতির খাদ্যের অধিকার সংরক্ষণ প্রমাণিত হয়েছে।
আর এটা প্রমাণিত হলো যে, তাদের অধিকার খর্ব করার হক আমাদের নেই। অনুরূপভাবে ঘর-বাড়ি থেকে তাদেরকে উজাড় করার বৈধতাও নেই। যতক্ষণ না তারা কষ্ট দেয়।
মূল: হাকিমুল ইসলাম মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব রহ.
অনুবাদ: মাওলানা লিসানুল হক
উৎস: ইনসানিয়াত কি ইমতিয়াজ এর অনুবাদ “মনুষ্যত্বের উন্নত বৈশিষ্ট্য” (আহমদ প্রকাশন) পৃষ্ঠা ১৭-২১ হতে সংগৃহীত ও পরিমার্জিত।
মন্তব্য করুন