[নিচের লেখাটা রাফায়েল হাসান ভাইয়ের নোট থেকে নেয়া ]
বিসমিল্লাহ। তাবিজ নিয়ে লেখব ভাবছিলাম কিছুদিন থেকে। আল্লাহর নামে শুরু করলাম। উস্তাদ টিম হাম্বল (হাফি)এর লেকচার থেকে বেশকিছু অংশ নেয়া হয়েছে।
একদল আলেম তাবিজ ব্যবহার করাকে সরাসরি শিরক বলে দেন। আরেকদল আলেম কিছু শর্তসাপেক্ষে তাবিজকে জায়েজ বলেন। তাদের মতে, স্পষ্ট কোরআনের আয়াত দিয়ে তাবিজ জায়েজ হবে। মানে কোরআনের আয়াত ছাড়া আর কোন লেখা থাকবেনা। আমাদের সমাজে বিভিন্ন সূরার নকশার তাবিজ প্রচলিত আছে। আফসোসের বিষয় হচ্ছে আগের কিছু কিছু কোরআনের কপিতে শেষের দিকে এসব নকশা লিখে দেয়া হত। আলেমরা জায়েজ তাবিজ বলেছেন শুধুমাত্র কোরআন স্পষ্ট করে লেখা থাকলে। অন্যকোন আরবি লেখা, নকশা, নাম্বার, নামতা এগুলো সম্পূর্ণ নাজায়েজ।
বর্তমানে সমস্যা নিয়ে মসজিদের হুজুর বা কোন আলেম বা কোন তথাকথিত কবিরাজের কাছে গেলে তারা আপনাকে একটা তাবিজ ধরিয়ে দিয়ে বলবে, এই নেন জাফরান দিয়ে লেখা তাবিজ দিলাম। গলায় ঝুলান। কোন সমস্যা হবেনা আর। কিন্তু তাদের কেউই আপনাকে বলবেনা রুকইয়া শারইয়্যা অথবা শরীয়তসম্মত রুকইয়াহ করেন, নিয়মিত আয়াতুল কুরসি, তিনকুল পড়েন। ইনশাআল্লাহ সমস্যা হবেনা। এতে অবশ্য তাদের কোন দুনিয়াবি লাভও নেই।
কেউ কেউ ডিম,মুরগি,মাছ ইত্যাদি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতে বলে। আবার কেউ কেউ এগুলোর দাম অনুযায়ী টাকা চেয়ে নেয়। তো এই মুরগি,ডিম দিয়ে তারা কি করে? এগুলোর সাথে ইসলামের সম্পর্ক কোথায়? এই লোক মুরগিকে শয়তানের উদ্দেশ্যে বলি দেয় কিনা সেটা আমরা জানতে চাইনা। যাই হোক, তাবিজে ফিরে আসি। যাদুকররা কিভাবে তাবিজ লিখে আসেন জানার চেষ্টা করি।
যাদুকরদের জন্য তাবিজ হল শয়তান জীনদের সাথে একটা কন্ট্রাক্ট বা চুক্তিপত্র। এটাকে ভিক্টিমের শরীরে ঝুলাতে বলে অথবা আশেপাশের কোথাও রেখে দিতে বলে। এই চুক্তিপত্রে যাদুকর শয়তানকে খুশি করার জন্য নানা হাবিজাবি লিখে রাখে। বিনিময়ে শয়তান তার কিছু কাজ করে দেয়। তবে শয়তান সবচেয়ে বেশি খুশি হয় আল্লাহর সাথে শরীক করলে, আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে, কোরআন অবমাননা করলে। তাই যাদুকর এই কাজগুলোই বেশি করে। তারা ফরজ নামাজ ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেয়, বিনা অযুতে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে, নামাজের সময় সিজদায় গিয়ে শয়তানের নাম নেয় ইত্যাদি যত প্রকার খারাপ কাজ যা আল্লাহর অপছন্দ সবকিছুই করে।
তারা কোরআনের বিভিন্ন আয়াত লিখে কখনো মহিলাদের পিরিয়ডের রক্ত, কখনো শয়তানের উদ্দেশ্যে বলি দেয়া পশুর রক্ত অথবা প্রস্রাব করে সেটাতে লাগিয়ে রাখে তাবিজ হিসেবে ব্যবহার করতে বলে। অনেক তাবিজে কোরআনের স্পষ্ট আয়াতের পাশাপাশি রক্তের দাগের মত হালকা লাল বা অপরিচিত কোন রঙের দাগ দেখা যায়। কখনো শয়তানের নাম লিখে তাবিজ দেয়। কখনো কোরআনের আয়াতের মাঝামাঝি শয়তানের নাম লিখে দেয়। কখনো কোরআনের একটা বা দুইটা শব্দ পরিবর্তন করে দেয়। এসব তাবিজ লেখার সময়ে শুরুতে এবং শেষে বড় করে বিসমিল্লাহ, আল্লাহ এসব শব্দ লিখে রাখে যাতে সাধারণ মানুষ বুঝে মাঝখানেও কোন সমস্যা নাই। একটা বা দুইটা শব্দ পরিবর্তন করে লিখলে সমস্যা কোথায়? দেখুন,
“আর স্মরণ কর, যখন তাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘এ জনপদে বাস কর ও যেখানে ইচ্ছা আহার কর এবং বল, ‘‘হিত্ত্বাহ’’ (ক্ষমা চাই) এবং নতশিরে (শহর)দরজা দিয়ে প্রবেশ কর, আমি তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করব। আমি শীঘ্রই সৎকর্মশীলদের জন্য আমার দান বৃদ্ধি করব।” (আরাফ,১৬১)
“অতঃপর তাদের মধ্য থেকে যারা যুলম করেছিল, তাদেরকে যা বলা হয়েছিল তার পরিবর্তে তারা অন্য কথা বলল। ফলে আমি আসমান থেকে তাদের উপর শাস্তি পাঠালাম, কারণ তারা যুলম করত।” (আরাফ, ১৬২)
এখানে তাদেরকে বলা হয়েছিল হিত্ত্বাহ বলার জন্য। কোন কোন তাসফীরকারক বলেছেন, তারা এই শব্দকে পরিবর্তন করে বলেছিল হিন্তাহ। শুধুমাত্র একটা শব্দ পরিবর্তন করায় আল্লাহ তাদের জন্য আসমান থেকে শাস্তি পাঠিয়েছিলেন। যাদুকররাও এই কাজটাই করে। এমনভাবে একটা বা দুইটা শব্দ পরিবর্তন করে দেয় যে সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা বুঝা সম্ভব হয়না আসলে কোন জায়গায় পরিবর্তনটা করেছে।
যাদুকরদের তাবিজের যেসব বই আছে সেগুলোতে বিভিন্ন তাবিজের ছবি দেয়া আছে। এই তাবিজগুলো কাজ করার জন্য যাদুকরকে কি কি করতে হবে সেগুলোর বিস্তারিত তথ্যও দেয়া আছে। তো তারা সেগুলো কপি করে লিখে ফেলে। আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেবরাও এসব তাবিজের কিতাব দেখে দেখে অনেক সময় তাবিজ লিখে দেন। অনেকেই মূলত না জেনে এভাবে লিখে দেন। আবার কেউ কেউ হয়ত জেনেশুনেই দেন। আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
যাদুকররা কোরআনের মধ্যে পিন গেঁথে, সেটাতে ময়লা লাগিয়ে অনেক সময় ড্রেনে ফেলে দেয়। এরকম কোরআনের কপি ড্রেন থেকে উদ্ধার করার ভিডিও ইউটিউবে আছে। এই ভিডিওটা দেখতে পারেন
যাদুকররা আরো কি কি করতে পারে জানতে এই ভিডিওটি দেখা যেতে পারে
আমাদের সমাজে এই যাদুকররাই ইসলামী লেবাসে ঘুরে বেড়ায়। এদেরকে আমরা যাদুকর হিসেবে চিনিনা। আমরা এদের কবিরাজ, তান্ত্রিক, ওঝা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে চিনি। কেউ কেউ কোরআনের হাফেজ, মাওলানা, ইমাম, মুফতি হয়েও এই কুফরি কাজে জড়িয়ে যায়।
নিচের তাবিজটা দেখা যাক। এক মসজিদের ইমাম সাহেব এটা ৩ মাস বয়সী এক বাচ্চার গলায় ঝুলাতে দিয়েছিলেন। মৌলভীবাজারের এক ভাই ইনবক্সে দিয়েছিলেন। উনার ভাতিজাকে দেয়া হয়েছিল এটা। এতে লেখা আছে ইয়া বাদ্দুহ। এটা শয়তানের নাম। এই তাবিজে তাদেরকে আহবান করা হয়েছে। এই তাবিজ কোনমতেই জায়েজ তাবিজের পর্যায়ে পড়েনা।
[১ নং ছবি দ্রষ্টব্য]
এবার নিচে আরেকটি তাবিজ আছে। এটা উস্তাদ টিম হাম্বলের ভিডিও থেকে নেয়া হয়েছে। এটা উস্তাদ নিজে ব্যখ্যা করেছেন। উনার ব্যখ্যাটাই বাংলায় লেখলাম।
এই তাবিজে দেয়া এরকম বহুভুজ, বৃত্ত এগুলো এবং এদের মধ্যে নাম্বার লেখা এরকম কোরআনের কোথাও নেই। এরকম বিভিন্ন আকৃতি এবং এর মধ্যে লেখা এগুলো যাদুকরদের সিল হিসেবে পরিচিত।
শামস আল মা’রিফ সহ যাদুর প্রায় প্রতিটা বইতেই এরকম আছে। তারা কিছু নির্দিষ্ট বিষয় সিল করে দিয়ে এভাবে তাবিজ লিখে। উপরে বড় করে লেখা নকশ নূরী এই কথাও কোরআনের না।
[২ নং ছবি দ্রষ্টব্য]
সবার উপরে অর্ধবৃত্তে লেখা “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযিম”। তো সাধারণ মানুষ প্রথমে এই লেখা পড়েই মনে করবে এটা তো আল্লাহর নাম নিয়েই শুরু করা হয়েছে! এতে সমস্যা কোথায়! এটা আসলে ধোকায় ফেলার জন্যই লেখা হয়েছে! বহুভুজের মধ্যে লেখা নাম্বারগুলো দুইভাবে ব্যখ্যা করা যায়। এগুলো ডিকোড করলে দেখা যাবে শয়তানকে খুশি করার জন্য কোন কথা আছে এর মধ্যে। অথবা এগুলো এমন কোন সময়ে লেখা হয়েছে যখন শয়তানের উপাসনা করা হয়। যেমন- সূর্যোদয়ের সময়।
যারকাশ কাওয়াআন নামক তাবিজের গল্পেও এরকম পাওয়া যায়। সাহাবারা (রা) এই তাবিজ পেয়েছিলেন। এটা পারস্যের এক তাবিজ। পারস্যের সেনাবাহিনী যখন যুদ্ধে যেত তখন এই তাবিজ সাথে করে নিয়ে যেত। এই তাবিজ মূলত ১০০ টা বর্গ ছিল ১০বাই১০ সাইজের। প্রতিটাতে কিছু নির্দিষ্ট কিছু নাম্বার, অক্ষর লেখা ছিল। এগুলো লেখা হত জ্যোতিষীদের হিসাবে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান হিসাব নিকাশ করে যা আসলে শয়তানের উপাসনার জন্য করা হয়। এটাতে শুধু কিছু নাম্বার আর অক্ষর ছিল। বর্তমান সময়েও যাদুকররা মনে করে এটা সবচেয়ে ভয়ংকর তাবিজ। আর এটা লেখা অনেক কঠিন এবং জটিলও। কারণ প্রতিটা অক্ষর বা নাম্বার দিন বা মাসের বিশেষ সময়ে লিখতে হয়। সাথে সূর্য চন্দ্রের অবস্থান এসবও খেয়াল রাখতে হয়। সাধারণত সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময়ে শয়তানকে খুশি করার জন্য এই তাবিজ লেখা হয়। আর রাসুল (সা) সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময়ে নামাজ পড়তে নিষেধ করেছেন। এই নাম্বার এবং সংখ্যা ডিকোড করলে দেখা যাবে এতে হাবিজাবি বিভিন্ন লেখা আছে যা শুধুমাত্র শয়তানকে খুশি করার জন্যই লেখা হয় অথবা পরিষ্কার ভাষায় শয়তানের নাম লেখা আছে। এসব তাবিজে আল্লাহর নাম মাঝখানে রেখে চারপাশে শয়তানের নাম লিখে রাখে। যেসব আলেম শর্তসাপেক্ষে তাবিজকে জায়েজ বলেন তাঁদের দেয়া কোন শর্তেই এটা পরেনা। এই তাবিজ জায়েজ হতে পারেনা।
এই তাবিজের নিচের অংশ পড়া যাক এবার। ছবিতে মার্ক করা আছে কালার দিয়ে। একজায়গায় লেখা ইয়া আতুফ, আরেক জায়গায় ইয়া বাদ্দুহ। ইয়া আতুফ আল্লাহর নাম নয়। এটা কার নাম সেটাও আমরা জানিনা। আল্লাহর কিছু নামের পরে হঠাৎ এই কথা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর বাদ্দুহ হল শয়তানের নাম। এটা প্রায় অনেক যাদুর বইতে স্পষ্ট করে বলা আছে। বাদ্দুহ আল্লাহর নাম নয়। কোরআন সুন্নাহর কোথাও আল্লাহর এই নাম আছে এরকম কথা উল্লেখ নাই। ইয়া বাদ্দুহ এর পরে লেখা হয়েছে বিহাক্ক। মানে সবকিছু মিথ্যা শুধু শয়তানের নাম ধরে ডাকার সময় এটা সত্যি।
[৩ নং ছবি দ্রষ্টব্য]
তারপর আরো হাবিজাবি অনেক কিছু লেখা হয়েছে। দরুদও লেখা আছে শেষের দিকে। কিন্তু মাঝখানে শয়তানের নাম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কোরআনের আয়াতও লেখা আছে। তারপর উর্দুতে লেখা আছে এটাকে বাসায়,ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রেখে দেয়ার জন্য। তারপর বলা আছে বাসার যেখানে টিভি আছে সেখানে না রাখতে!
এই তাবিজ স্পষ্টতই শিরক। এভাবে যাদুকরদের তাবিজ ব্যবহার করে আমরা আমাদের ঈমান নিজের অজান্তেই প্রশ্নবিদ্ধ করছি। আর আল্লাহর সাথে শিরক করা অবশ্যই ভয়াবহ রকমের গুনাহের কাজ। কোন তাবিজ জায়েজ কিনা সেটা চেক করার মত জ্ঞান আমাদের অনেকেরই নাই। আর যারা তাবিজ ব্যবহার করেন কেউই তাবিজ খুলে চেক করেন না আসলে কি লেখা আছে এতে। তো এতে লাভ হচ্ছে শয়তানেরই। আমাদেরকে গোমরাহ করার যে উদ্দেশ্য নিয়ে সে এসেছে তাতে সে সফল হয়ে যাচ্ছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে আপনি রাস্তা থেকে ১০০ টা লোক ধরে নিয়ে তাদের গায়ের তাবিজ খুলে চেক করলে এসবই পাবেন। জায়েজ তাবিজের শর্ত পূরণ করে এমন তাবিজ হাজারে একটা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তাই আসুন তাবিজ থেকে দূরে থাকি। শয়তানকে কোন সুযোগ না দেই।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“হে বনী আদম, শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে, যেভাবে সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল…।” (সুরা আরাফ, আয়াত ২৭)
আসেন ভাই তাবিজ বর্জন করি, নিজেকে সেইফ সাইডে রাখি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে শিরক এবং কুফর থেকে মুক্ত করে সহজ সরল পথের উপর অবিচল রাখুন। আমিন।