Ruqyah Support BD

সম্পর্ক নষ্টের যাদুর রুকইয়াহ : যাদুগ্রস্ত ৫

কারো সাথে কারো সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য বান মারলে / তাবিজ করলে / যাদু করলে দেখা যায়- সব ভালোই ছিল, হঠাৎ একজন অপরজনকে সহ্য করতে পারছেনা। এই যাদু যেমন স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরাতে করে, তেমন পরিবারের অন্যান্য সদস্য যেমন পিতা-মাতা-ভাই-বোন এসব সম্পর্কে ফাটল ধরাতেও করা হয়। দুই বন্ধু, ব্যবসার পার্টনারদের মাঝে ঝামেলা বাধাতেও করা হয়। আর কখনো এমন হয়, বিয়ের আগে কেউ যাদু করে রেখেছে, বিয়ের পর স্বামীস্ত্রীর কোনোভাবেই মিলছে না। তো যাইহোক এই যাদুর পরিধি যেমন ব্যাপক, এর প্রাচীনকাল থেকে চর্চাও অনেক বেশি। এমনকি এই যাদুর কথা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা কোরআনে বলেছেন- “..অতঃপর তাদের কাছে তারা এমন জাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামীস্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে…।” [বাকারা:১০২]

আমাদের আলোচনা স্বামীস্ত্রীর কথা উল্লেখ করেই করা হবে, এই অনুযায়ী অন্য সম্পর্কগুলোতেও পাঠকরা মিলিয়ে নিবেন। এই যাদুতে আক্রান্ত হলে সচরাচর কিছু লক্ষণ দেখা যায়-

১. স্বামী বাহিরে থাকলে স্ত্রী ভালো থাকে, বাড়িতে আসলেই মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যায়

২. দুজনের কেউ খুব বেশি সন্দেহপ্রবন হয়ে যায়

৩. ছোটছোট বিষয়ে ছাড় দিতে চায়না, ঝগড়া বেধে যায়

৪. স্ত্রী দেখতে যেমনই হোক, স্বামীর কাছে খারাপ লাগে, ভালো আচরণ করলেও ভালো লাগেনা।

৫. স্বামী একটা যায়গায় বসেছে, বা একটা জিনিশ ব্যবহার করেছে ওই জিনিশটাও স্ত্রী অপছন্দ করে।

৬. অন্যদের সাথে আচরণ স্বাভাবিক, কিন্তু স্বামীস্ত্রী কথা বার্তা বলতে গেলেই উলটাপালটা শুরু হয়ে যায়।

এরকম ঘটনা যদি সচরাচর ঘটতেই থাকে, তবে বুঝতে হবে কোনো একটা ঘাপলা আছে। আর কথা হচ্ছে, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই সব লক্ষণ মিলবে তেমন না! তবে সমস্যা থাকলে অন্তত ২-৩টা মিলে যাওয়ার কথা।
.
গুরুত্বপূর্ণ নোটঃ এই যাদুর ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে, এই যাদু করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জ্বিন দিয়ে করা হয়, পাশাপাশি এমনি যাদুও করা হয়। অর্থাৎ মাল্টিপল মাস! এজন্য প্রথমত: সাজেস্ট করবো কোনো আলেমের কাছে গিয়ে রুকইয়া করিয়ে নিন। তবুও নিজে রুকইয়া করতে চাইলে বলবো, এই সমস্যার জন্য সেলফ রুকইয়ায় ইনশাআল্লাহ অনেকেই ভালো ফল পাবেন, তবে যদি জ্বিনের সমস্যা বুঝতে পারেন, তবে কোনো আলেমকে দিয়ে রুকইয়া করানোই উত্তম হবে।

দ্বিতীয়ত: এই যাদুর চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিউর হতে অনেকের লম্বা সময় লাগে, এজন্য ধৈর্যহারা হওয়া যাবেনা। সবরের সাথে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

মনে রাখবেন, আপনার শত্রু আপনার ক্ষতি করলেই সফল হয়ে যায়না, সে তখনই সফল হয়, যখন আপনি সমাধানের ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেন। শয়তান আপনাকে দিয়ে গুনাহ করালেই সফল হয়না, বরং শয়তান তখনই সফল হয়, যখন আপনি নিরাশ হয়ে তাওবা করা ছেড়ে দেন। এজন্য একবার যদি বুঝতে পারেন সমস্যা আছে, তবে এর শেষ না দেখে ছাড়বেন না। Keep moving forward!

সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটানো যাদুর জন্য রুকইয়া:

১. প্রথমে উপরের লক্ষণগুলোর ব্যপারে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হোন, এরপর তৃতীয় পর্বে বলা নির্দেশনা অনুযায়ী পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আপনি রুগীর পাশে বসে জোর আওয়াজে রুকইয়ার আয়াতগুলো পড়তে থাকুন, মাঝেমধ্যে ফুঁ দিবেন। যদি জ্বিনের সমস্যা থাকে তবে রুগীর ওপর জ্বিন চলে আসবে, তখন জ্বিন সিরিজের ৬ষ্ঠ-৭ম পর্বে যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে সামলাবেন। জ্বিন এলে জিজ্ঞেস করবেন- ‘কিভাবে যাদু করেছে, যেসব জিনিশ দিয়ে যাদু করেছে, সেগুলো কোথায় আছে’। জ্বিনেরা যদিওবা খুব বেশি মিথ্যুক, তবুও যদি বলে ভালো, না বললে নাই।

সম্ভব হলে এটা জিজ্ঞেস করে, তারপর জ্বিন তাড়াবেন। আর যদি কোনো যায়গার কথা বলে সেখানে লোক পাঠিয়ে যাদুর জিনিশপত্র খুঁজে বের করবেন, সত্যি বলে থাকলে পাওয়া যাবে, মিথ্যা বললে পাবেন না। যদি খুঁজে পান তবে “সুরা বাক্বারা ১০২, সুরা আ’রাফ ১১৭-১২২, ইউনুস ৮১-৮২, সুরা ত্বহা ৬৯” এই আয়াতগুলো পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে যাদুর জিনিশপত্র কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হবে, তাহলে ইনশাআল্লাহ যাদু নষ্ট হয়ে যাবে।
যদি বলে কোনোকিছু খাইয়ে যাদু করা হয়েছে, বা যাদুর পানি রাস্তায় ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে তবে তবে তবে সরাসরি নিচের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করতে বলে দিন, এবং বলুন ১ সপ্তাহ পর যেন আপডেট জানায়।

যদি জ্বিন বলে অমুক যায়গায় যাদুর জিনিশ লুকানো আছে, কিন্তু আমি বিস্তারিত জানিনা। তাহলে উপরের আয়াতগুলো পড়া পানি ওঁই যায়গায় কয়েকদিন ছিটালে ইনশাআল্লাহ যাদু নষ্ট হয়ে যাবে।

২. আর যদি জ্বিন না আসে। এমনি খুব অস্বস্তি বোধ করে, রুকইয়ার সময় টায়ার্ড হয়ে পড়ে, খুব মাথাব্যথা করে, কান্না পায়-তাহলে বুঝবেন জ্বিন দিয়ে যাদু করেনি, অন্যভাবে করেছে। তাহলে আরও ২/৩বার রুকইয়া করে দেখুন। এরপর [ঘ] পয়েন্টের প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিন, এবং বলুন অবস্থা যেমনি হোক ১ সপ্তাহ পর যেন আপডেট জানায়।

৩. এক সপ্তাহ পর আবার শুরু থেকে রুকইয়া করে দেখুন, সমস্যার একদম ভালো হয়ে গেলে তো আলহামদুলিল্লাহ! হয়েই গেলো, আর পুরাপুরি ভালো না হলে তো বুঝতেই পারবেন, জ্বিনের সমস্যা হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন, আর যাদুর সমস্যা হলে আবার সেইম প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিন। ইনশাআল্লাহ আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাবে।

বিচ্ছেদের যাদুর জন্য সেলফ রুকইয়া:

১. আগেও বলেছি, এই যাদুর ক্ষেত্রে অনেক সময় সেলফ রুকইয়া যথেষ্ট হয় না, সরাসরি রুকইয়া করা লাগে। তবুও যদি নিজে রুকইয়া করতে চান, তবে বলবো একজন আলেমের সাথে যোগাযোগ রাখুন, যেন সমস্যা হলে তাঁর সহায়তা নিতে পারেন। তো বরাবরের মতই বলবো, নিজে নিজে রুকইয়া করলে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার মত একজন থাকা উচিৎ, নইলে অনেককে কয়েকদিন গেলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে দেখা যায়।

২. ভালোভাবে পাক-পবিত্র হয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ুন। এরপর দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে আপনার সমস্যা থেকে ‘পরিত্রাণের’ জন্য এবং সুস্থতার জন্য দু’আ করে ইস্তিগফার দরুদ শরিফ পড়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করুন। হাতের কাছে এক বোতল পানি নিয়ে বসুন। প্রথমে সিহরের রুকইয়া (ডাউনলোড পেইজের ২ নাম্বারেরটা) অথবা শাইখ সুদাইসের বা অন্য কোনো ক্বারির সাধারণ রুকইয়া শুনুন। সমস্যা থাকলে অবশ্যই বুঝতে পারবেন, যেমন: অনেক ঘুম ধরবে, মাথাব্যথা করতে পারে, কিছু খাইয়ে যাদু করলে পেটব্যথা করবে, বমি বমি লাগতে পারে, হাতপা ব্যথা করতে, খুব টায়ার্ড লাগতে পারে। এরকম কিছু হলে বুঝে নিবেন সমস্যা আছে। আর উপরে তো লক্ষণ বলেছিই, যদি ২-৩টা মিলে যায়, তবে নিচের প্রেসক্রিপশন ফলো করুন।

৩. ৭দিন পর আবার রুকইয়া করুন, ভালো না হলে আরো ৭দিনের মেয়াদ বাড়িয়ে নিন।

প্রেসক্রিপশন:

১. একটা বোতলে পানি নিয়ে “সুরা বাক্বারা ১০২, আ’রাফ ১১৭-১২২, ইউনুস ৮১-৮২, সুরা ত্বহা ৬৯” আয়াতগুলো পড়ে ফুঁ দিন। এখনি কিছুটা খেতে হবে, বাকিটা রেখে দিবে। আর এরপর এই পানি দুইবেলা করে খেতে হবে। আর প্রতিদিন গোসলের পানিতে কিছু পানি মিশিয়ে গোসল করতে হবে।

২. সুরা ইয়াসিন, সুরা সফফাত, সুরা দুখান, সুরা জ্বিন- ৩বার শুনতে হবে, অথবা তিলাওয়াত করতে হবে হবে। কোনো দিন খুব ব্যস্ত থাকলে অন্তত একবার হলেও শুনবেন। (এই ৪টা সুরা একসাথে ডাউনলোড লিংক কমেন্টে) চাইলে প্রতিদিন শোনার ক্ষেত্রে অন্য কারো হেল্প নিতে পারেন, অর্থাৎ অন্য কেউ যদি আপনার সমস্যার নিয়াতে রুকইয়া শোনে তবুও আপনি উপকার পাবেন।

৩. তবে যদি যাদুর সাথে জ্বিনের সমস্যাও থাকে, তাহলে প্রতিদিন এই চারটা সুরা একবার শুনবেন, এবং আয়াতুল কুরসি শুনবেন ১ থেকে দেড় ঘণ্টা।

৪. প্রতিদিন ১০০বার ইস্তিগফার এবং “লা-হাওলা ওয়ালা ক্বুওওয়াতা ইল্লা-বিল্লাহ” পড়বেন। বেশি পড়লে আরো ভালো।

৫. রুকইয়া ভালোভাবে কাজ করার জন্য গানবাজনা শোনা যাবেনা। নামাজ-কালাম ঠিকঠাক পড়তে হবে। ফরজ ইবাদাতে যেন ত্রুটি না হয়। (মেয়েদের পর্দা করাও ফরজ)

৬. ঘুমের আগে আয়াতুল কুরসি পড়বেন। আর ৩ ক্বুল তিনবার পড়ে হাতে ফুঁ দিয়ে পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে নিবেন।

৭. সকাল সন্ধ্যার মাসনুন দোয়া, এবং ৩ ক্বুল (সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস)এর আমল ঠিকঠাক করবেন।

লক্ষণীয়ঃ আজকের আলোচনায় সুরা বাঁকারার ১০২ নং আয়াতের কথা রয়েছে, যা গতদিন (বিয়ে ভাঙার যাদু)-এর আলোচনায় ছিল না।

গুরুত্বপূর্ণ নোট: 

এই বিচ্ছেদের যাদু একদম ভালো হতে হতে অনেকেরই কয়েক সপ্তাহ বা মাসখানেক লেগে যায়। আর রুকইয়া শুনতে থাকলে, সাথে পানি খেতে এবং গোসল করতে থাকলেও প্রথম ১০ থেকে ১৫ দিন সমস্যা বাড়ে, এরপর আস্তে আস্তে কমতে কমতে মাসের শেষের দিকে একদম ভালো হয়ে যায়। 

সবার ক্ষেত্রেই এমন হয় যে তা বলছি না। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই হয়, এজন্য অগ্রিম জানিয়ে রাখা ভালো, সমস্যা বাড়তে দেখলে যেন রুকইয়া করা বাদ না দেন। প্রথম প্রথম সমস্যা বাড়তে পারে, পরে আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। অন্য কারো জন্য রুকইয়া করলেও প্রেসক্রিপশন দেয়ার সময় এই কথাটা বলে দিবেন।

আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন। আমীন।

<< আগের পর্ব | পরের পর্ব >>

মন্তব্য করুন