আয়াত কাস্টমাইজেশনের ধোকা – রুকইয়ার সমস্যা সমগ্র ৩

পর্ব – ১
——–

[ক]
রুকইয়া চলাকালীন অনেকে বিষয় ভিত্তিক আয়াতের ইফেক্ট দেখে ধোকায় পড়েন।
যেমন, জ্বিনের আয়াতগুলো পড়লে কষ্ট বেশি হচ্ছে, আর সিহরের আয়াত পড়লে কম হচ্ছে। অথবা জিনের আয়াতে কষ্ট হয়নি শুধু জাদুর আয়াতগুলোতে সমস্যা হচ্ছে, তখন অনেক রাকি খুব দ্রুত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বসেন যে, রোগীর জাদু-টোনার সমস্যা আছে।
বাস্তবতা হল, এটা এমন কোন ধ্রুব সত্য না যে, জাদুর রোগির সিহরের আয়াতেই ইফেক্ট বেশি হবে, নজরের রোগির আইন-হাসাদের আয়াতেই ইফেক্ট বেশি হবে। হ্যাঁ, প্রায়শই ‘সিহর’ উল্লেখিত আয়াত পড়ায় জাদুর রোগীর ইফেক্ট দেখা যায়। কিন্তু অন্য আয়াতেও ইফেক্ট হতে পারে। বরং এরকম আয়াত বিভাজনের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিলে, শয়তান আপনাকে নিয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে যায়!

[খ]
এবিষয়ে উস্তায তিম হাম্বল এক ওয়ার্কশপে বলেছিলেন, “আপনার রুকইয়ার প্ল্যান আগেই ঠিক করে নেন এবং সে অনুযায়ীই শেষ করেন। প্রয়োজনে আবার রুকইয়া করেন। আপনার রুকইয়া সেশন জিনকে পরিচালনা করতে দিয়েন না!! অর্থাৎ জিনের লাফালাফি দেখে আপনি সে অনুযায়ী আয়াত পাঠ করছেন, এখানে-ওখানে আয়াত চেঞ্জ করছেন, পড়া বন্ধ করে দিচ্ছেন… এভাবে আপনি খুব সহজেই শয়তানের ধোঁকায় পড়বেন।
ধোকার অনেক কারণ আছে, তার মধ্যে বড় একটা কারণ হল, আপনি তো জিনকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন না, হয়তোবা যে আয়াতগুলোতে কষ্ট হয়েছে সেখানে দাঁতে দাঁত চেপে বসে ছিল, আর যেখানে কষ্ট কম হচ্ছে সেখানে ব্যথা পাওয়ার মিথ্যা নাটক করছে। এরকম হতেই পারে, অস্বাভাবিক কিছু না।”

[গ]
দুদিন আগের কথাই বলি, যে জ্বিনের রুকইয়ার কথা শেয়ার করেছিলাম, (অনেক কষ্ট হয়েছে বের হতে, ওইটা..) উনার রুকইয়ার সময় খুব বেশি প্রভাব দেখা গেল বদনজরের আয়াতগুলো পড়ার সময়ে! কিন্তু আমরা তো খুব ভালো ভাবেই জানি যে, উনার জিনের সমস্যা আছে।
তাহলে এমন কেন হল?

– এই রোগীর ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, প্রথমে শুরু করার পর থেকেই জিনের কষ্ট হয়েছে, কিন্তু সে কষ্ট সহ্য করেছে। সহ্য করতে করতে একদম শেষে যখন বদ নজরের আয়াতগুলো পড়ছিলাম তখন তার সহ্যক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে, এরপর চিল্লাচিল্লি শুরু করেছে।
সত্য কথা হলো, যে আয়াতই পড়েন না কেন আপনি, শয়তান কমবেশি কষ্ট পাবেই, কিন্তু কতক্ষণ সহ্য করতে পারছে সেটাই বিষয়।
.
মজার ব্যাপার হলো সূরা নাস পর্যন্ত পর যখন আবার শুরুর দিকের আয়াতগুলো পড়েছি, তখন কিন্তু ঠিকই কষ্ট হয়েছে। যে আয়াতগুলোতে প্রথমবার একদম চুপ করে ছিল, পরেরবার সেই একই আয়াতে কান্নাকাটি করেছে, হাতজোড় করে মাফ চেয়েছে।

এরকম অনেকবার দেখেছি যে, সিহরের আয়াত পড়লে জিনের কষ্ট হচ্ছে। আর জিন সংক্রান্ত আয়াত পড়লে সিহরের রোগির মাঝে ইফেক্ট দেখা যাওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। কারন অনেক জাদুর সাথে জিন জড়িত থাকে।

[ঘ]
অতিরিক্ত কাস্টমাইজ করলে আরও কিছু সমস্যা আছে, ভবিষ্যতে এটা নিয়ে বিস্তারিত কথা হবে ইনশাআল্লাহ। আজ সংক্ষেপে কয়েকটা পয়েন্ট বলি-
১. এর দ্বারা মাসনুন রুকিয়ার উপর আপনাকে ভরসা কমে যায়।
২. এরকম বিভিন্ন যায়গার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাঙ্গা আয়াত পাঠ করলে, রোগীর ওপর সাইড ইফেক্ট অনেক বেশি হয়।
এজন্য খেয়াল করে দেখবেন, দীর্ঘদিনের জন্য রুকইয়া প্ল্যান দেয়া হলে অভিজ্ঞ শাইখরা সূরা বাকারা, ৮ সুরার রুকইয়াহ, আয়াতুল কুরসি, ৩কুল- এরকম সলিড তিলাওয়াত শুনতে বলেন। আমার মনে হয়, এগুলোতে তাৎক্ষণিক ইফেক্ট কম হলেও, দীর্ঘমেয়াদে ফায়দা অনেক বেশি হয়। আল্লাহ সবচেয়ে ভাল জানেন!
৩. আপনার মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, তিলাওয়াতের ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটে, যখন আপনি বিভিন্ন জায়গা থেকে ছড়ানো-ছিটানো আয়াত তিলাওয়াত করেন।
শাইখ লুহাইদানের সাধারণ তিলাওয়াত আর রুকইয়ার তিলাওয়াতের তুলনা করলে এব্যাপারে কিছুটা ধারনা পাবেন।
৪. যেটা পূর্বে বললাম, ইফেক্টের ব্যাপারে জিন আপনাকে ধোঁকা দিতে পারে।
৫. আপনি ডায়াগনোসিসের ভুল করতে পারেন।
অর্থাৎ জিনের রোগিকে নজরের পেশেন্ট মনে করে, জাদুর রোগিকে কিংবা মানসিকভাবে অসুস্থ রোগিকে জীনের রোগি ভেবে ধোকা খেতে পারেন। চিকিৎসায় ভুল করতে পারেন।

[ঙ]
রুকইয়াহ শারইয়াহ দুইভাবে ফায়দা দেয়,
১. দোয়া বা রহমত প্রার্থনা
২. স্পেল ইফেক্ট
মাসনুন রুকইয়ার মাঝে সাধারণত ওপরের দুইটাই থাকে। আর বিষয়ভিত্তিক আয়াতে সাধারণত দ্বিতীয়টার প্রাধান্য থাকে।
আমাদের উচিত রুকইয়ার দোয়া ফর্মের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া।


পরিশেষে বলব, আমার খেয়াল হল, বিষয়ভিত্তিক আয়াত পড়েন, এর দ্বারা উপকৃত হোন সমস্যা নাই। কিন্তু এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভর কইরেন না। বিশেষত চিকিৎসার প্রাথমিক লেভেলে এটা আপনাকে বাজে ধরনের বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে..।

আল্লাহ আমাদের সব ভুলভ্রান্তি এবং শয়তানের ধোকা থেকে হিফাজত করুন। আমিন।


পর্ব – ২  (১৬.০১.২০২০)
——–

[ক]
কিছুদিন আগে আমরা “রুকইয়ার মাঝে অতিরিক্ত কাস্টমাইজেশন করার সমস্যা” নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। কেউ কেউ ভালোভাবে নিয়েছেন, কেউ আবার পাত্তা দেননি।
কদিন আগে নামের পূর্বে রাকি যুক্তকারী এক ভাই তো বেন হালিমার মত আয়াতের লিস্ট দিয়ে দিয়েছে, ‘পাখি জিন হইলে এই আয়াত, হাতি জিন হলে এই আয়াত, ঘোড়া জিন হলে এই আয়াত।’
এগুলো নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি ভাই। এই বাড়াবাড়ির কারণে কোরআনের রূহানিয়্যাত, রুকইয়ার সুরতে দোয়ার আকুলতা কিংবা রহমানের কাছে নিজেকে তুচ্ছ করে উপস্থাপনের অভ্যাস; এই সবকিছুতেই ভাটা পড়ে। এরপর আবার অদৃশ্যের ব্যাপারে এভাবে মন্তব্য করা, এসবের ফলে রাক্বি এবং তার ওপর আস্থা রাখা রোগীরা পতিত হন সুদুর ভ্রান্তিতে।
আপনি এধরনের রাক্বিদের দেখবেন জ্বিন অথবা জ্বিন প্রভাবিত রোগীর বক্তব্যকে খুব গুরত্ব দিতে। এমনকি কিছু রাক্বি জিন-শয়তানের কাছে কিয়ামতের আলামত বিষয়ে প্রশ্ন করে, এরপর সেসব ভিডিও করে ইউটিউব – ফেসবুকে আপলোড দেয় : “ইলুমিনাতি সম্পর্কে কী বলল ইবলিসের নাতি! দেখুন ভিডিওসহ!!”

[খ]
দ্বিতীয়তঃ এটা দোয়ার মাঝে বাড়াবাড়ির অনুরূপ কাজ। যে ব্যাপারে অনেক সাহাবায়ে কিরাম থেকে ধমকি বর্ণিত আছে।
‘আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফ্‌ফাল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি তাঁর পুত্রকে দু’আ করতে শুনলেনঃ হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি, আমি যখন জান্নাতে প্রবেশ করলে জান্নাতের ডান দিকে যেন সাদা অট্টালিকা থাকে। (একথা শুনে) ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, হে বৎস! আল্লাহ্‌র নিকট জান্নাত প্রার্থনা কর এবং জাহান্নামের আগুন থেকে আশ্রয় চাও। কারণ আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বলতে শুনেছিঃ শীঘ্রই এ উম্মাতের মধ্যে এমন একদল লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা পবিত্রতা অর্জন ও দু’আর ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে।
– সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৯৬
.
সা’দ (রা) তাঁর এক ছেলেকে এই বলে দোয়া করতে শুনলেন যে, হে আল্লাহ,
নিংসন্দেহে আমি আপনার কাছে জান্নাত ও তার সুখ-শান্তি কামনা করি, এবং জান্নাতের মূল্যবান রেশমি বস্ত্র ও অনুরূপ (মূল্যবান জিনিস) কামনা করি, আর আপনার কাছে পানাহ চাই জাহান্নাম থেকে এবং তার শিকল ও তীব্র পিপাসা থেকে।
সা’দ রা. বলেন, হে বৎস! আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বলতে শুনেছি: এমন সম্প্রদায় আসবে যারা তাদের দোয়ায় সীমা-লঙ্ঘন করবে। সাবধান তুমি তাদের দলভুক্ত হবে না। তোমাকে যদি জান্নাত দেয়া হয় তাহলে এর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু সমেত দেয়া হবে। আর যদি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয় তাহলে জাহান্নাম ও তার মধ্যে যতো খারাপি আছে তার থেকে মুক্তি দেয়া হবে।
– মুসনাদে আহমাদ : ১/১৭২

[গ] (August 2, 2019)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা বলেন: আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যেমন ধারণা করে, আমি তেমনই। (তেমনই আচরণ করি বা তেমনভাবেই সাহায্য করি)। যে যখন আমাকে স্মরণ করে, তখন আমি তার সাথে থাকি। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে আমিও মনে মনে তাকে স্মরণ করি। আর যদি সে কোন মজলিসে আমাকে স্মরণ করে, তাহলে আমি তাকে এর চাইতে উত্তম মজলিসে (ফেরশতাদের সামনে) স্মরণ করি। আর যদি আমার দিকে অর্ধহাত এগিয়ে আসে আমি এগিয়ে আসি এক হাত। আর যদি আমার দিকে একহাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে দু’হাত এগিয়ে আসি। আর সে যদি আমার দিকে হেটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই..।
– বুখারী ৭৪০৫; মুসলিম ২৬৭৫

কোন রাক্বি ভাই যদি ধারণা করেন, অমুক সূরার ১৭০ নং আয়াত ১৭০বার পাঠ করা কিংবা মাউন্ট এভারেস্টের চুড়ার বরফ ছাড়া রুকইয়াহ করে সফল হওয়া যাবে না। তাহলে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য সাহায্য মাউন্ট এভারেস্টের চুড়াতেই তুলে রাখবেন।
আর কেউ যদি ইয়াক্বিন রাখেন যে, নাহ! মাসনুন রুকইয়াহ কিংবা সালাফদের থেকে পাওয়া সহজ রুকইয়ার সহজ সরল পদ্ধতিই আমার জন্য যথেষ্ট। বাকিগুলো অতিরিক্ত। তাহলে তারজন্য আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তিও বি-ইযনিল্লাহ এরকম সহজই হবে।

[ঘ]
উপসংহারে পুরান কথাই নতুন করে বলি: রুকইয়ার সাথে সাথে উদ্ভট পদ্ধতি ফলো করা রাক্বিদের রুকইয়া এবং ম্যালপ্র‍্যাকটিসের তাৎক্ষণিক প্রভাব, সাইড ইফেক্ট এবং অস্বাভাবিক মুভমেন্ট থেকে রাক্বি এবং দর্শকরা ভেবে থাকে ‘এটা হয়তো মাসনুন রুকইয়া কিংবা সালাফে সালেহীনদের অনুসৃত রুকইয়ার চেয়ে বেশি কাজে দিচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবে তাদের দীর্ঘদিনের রুকইয়ার চিত্র একসাথে করলে আসল করুণ চিত্র বেরিয়ে আসে।
.
এক্ষেত্রে রোগীর ভাগ্য ভালো থাকলে তো ওই রাক্বির কবল থেকে বেচে যায়, নইলে দিন শেষে চট্টগ্রামের সেই ৬ লাখ জিন মারা ভাইয়ের মত রুকইয়া করাতে গিয়ে মানসিক অসুস্থ হয়ে ফিরে।
এজন্য ভাই! আমরা চোখ ধাঁধানো তেলেসমাতি কারবারের ব্যাপারে সাবধান হব। সাধারণ রুকইয়াহ শারইয়ার ওপর স্ট্রিক্ট থাকব। সবর করব আর দোয়া করব।
আল্লাহ তাওফিক দিক।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সবসময় হিদায়াতের ওপর অবিচল রাখুক। আমিন।

মন্তব্য করুন